‘আত্মহত্যা’ মানতে নারাজ ফারদিনের বাবা; বললেন, ‘গল্প শুনতে হল’

ফারদিনের বাবা এখনও বলছেন, তার ছেলেকে অপহরণ করে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2022, 01:34 PM
Updated : 15 Dec 2022, 01:34 PM

ছেলে আত্মহত্যা করেছেন, তা মানতে নারাজ ফারদিন নূর পরশের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা। গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব যে তথ্য প্রমাণ দেখিয়েছে, তা সন্তুষ্ট করতে পারেনি তাকে।

নদী থেকে ফারদিনের লাশ উদ্ধারের ৪০ দিন পর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং র‌্যাব উভয় সংস্থা জানায়, এই বুয়েটছাত্র হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছেন।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে পাওয়া তথ্য প্রমাণ দেখতে বৃহস্পতিবার ডিবি কার্যালয়ে যান বুয়েটে তার সহপাঠীরা। তখন সেখানে ফারদিনের বাবাও উপস্থিত হন। তবে তাকে ওই সব তথ্য প্রমাণ আগেই দেখায় ডিবি ও র‌্যাব।

ডিবির হাতে থাকা আলামত দেখে কিছু প্রশ্ন থাকলেও ফারদিনের মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে বুয়েটছাত্ররা।

তবে সাংবাদিক নূরউদ্দিন রানা বলছেন, ভিডিও দেখে তার মনে হয়েছে, ওই রাতে ফারদিন স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না। তার ছেলেকে অপহরণ করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

Also Read: বুয়েট ছাত্র ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে: ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক

Also Read: হিসাব মেলাতে পারছেন না ফারদিনের সহপাঠী-স্বজনরা

Also Read: সেই রাতে ৪ স্থানে ঘোরেন ফারদিন, যাত্রাবাড়ী থেকে ওঠেন লেগুনায়: ডিবি

Also Read: ফারদিন খুন হননি, আত্মহত্যা: ডিবি-র‌্যাব

Also Read: ‘আত্মহত্যা’ মানতে নারাজ ফারদিনের সহপাঠীরা, ‘কনভিন্সড’ নন বাবাও

বুয়েটের পুরকৌশলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন (২৪) ঢাকার ডেমরার কোনাপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন।

গত ৪ নভেম্বর দুপুরে কোনাপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি; বলে গিয়েছিলেন, পরদিন তার পরীক্ষা রয়েছে বলে রাতে বুয়েটের হলেই থাকবেন। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরবেন।

কিন্তু পরদিন পরীক্ষায় তার অনুপস্থিত থাকার খবর জেনে খোঁজাখুজি করে ছেলেকে না পেয়ে থানায় জিডি করেন নূরউদ্দিন রানা। তিন দিন পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে লাশ পাওয়া যায়।

ফারদিনের লাশের ময়নাতদন্তের পর হত্যার আলামত পাওয়ার কথা বলেছিলেন নারায়ণগঞ্জের হাসপাতালের চিকিৎসক শেখ ফরহাদ। তখন ফারদিনের বাবা হত্যা মামলা করলে তার তদন্তভার পায় ডিবি, পাশাপাশি ছায়া তদন্তে নামে র‌্যাব।

তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে ফারদিনের পরিবার ও সহপাঠীদের অসন্তোষের মধ্যে বুধবার ডিবি ও র‌্যাব উভয় পক্ষ আলাদাভাবে সাংবাদিকদের জানায়, ৪ নভেম্বর মধ্যরাতে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এই তরুণ।

ফারদিনের আত্মহত্যার প্রমাণ হিসেবে রাতের ওই সময়কার একটি সিসি ক্যামেরার একটি ভিডিও দেখানো হয় তার সহপাঠীদের। তার বাবাকে তা দেখানো হয়েছিল কদিন আগেই।

নূরউদ্দিন রানা বলেন, “যেটা দেখানো হয়েছে, সেটা ব্রিজের উপর কী একটা … নড়ছে আর ঝুপুথ (ঝপ)করে পড়েছে। আর এই হল আমার ছেলে ফারদিন আত্মহত্যা করেছে!

সেই ভিডিও নিয়ে তিনি বলেন, “ব্রিজের একটা রেলিং ধরে যদি দাঁড়ায়, তার আগে বাহুতে ঘর্ষণ লাগবে, তার ওজন ৭০-৮০ কেজি ওজন হবে। এই গল্প আমাদের শুনতে হল!

“ব্রিজের উপর গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ অ্যাকটিভ হল, আর কোথাও কোনো সিসিটিভি ফুটেজে ফারদিনের সাবলীল চলাফেরা দেখাতে পারেননি কেন?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।

এর আগে ফারদিনের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে এবং বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ভিডিও বিশ্লেষণ করে ডিবি সেই রাতে ঢাকার চারটি স্থান ঘুরে যাত্রাবাড়ী থেকে তার ডেমরা সেতু হয়ে রূপগঞ্জের তারাবমুখী একটি লেগুনায় উঠতে দেখার কথা জানিয়েছিল।

ফারদিনের বাবা বলেন, “কোথাও একটা কেউ দেখাতে পারেনি আমাকে আজকে পর্যন্ত যে তাকে এভাবে ঘুরতে দেখা গেছে। সে যেই যেই জায়গাতে যাওয়ার নয়, কেরানীগঞ্জে গিয়েছে, স্যুইটেবল জায়গা খুঁজবার জন্য? আত্মহত্যা করবার জন্য?”

তার বিশ্বাস, এই সময়ে ফারদিনকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

“নিখোঁজ হয়েছে, চার ঘণ্টা গুম করেছে। তাকে কে কোথায় কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল, তার কোনো হদিস উনারা কেউ দিতে পারেননি।”

সেই রাতে পরিকল্পিতভাবেই ফারদিনকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

“তারা জানে, মোবাইল ডিভাইস ধরে কাজ হবে। সুতরাং মোবাইল ডিভাইস ধরে তাকে এখানে ওখানে, যেখানে যাবার নয় সেখানে ঘুরিয়েছে। তারপর এক জায়গায় সিন করিয়েছে যাত্রাবাড়ীতে।

“তারা যখন যাত্রাবাড়ীর ফুটেজ দেখিয়েছে, তখন বলেছি আমার ছেলে ‘প্যানিকড’ আছে। তার হাঁটাচলা স্বাভাবিক নয়। সে যেন ঝড়ের বেগে টেম্পুতে উঠে গেল কোনাপাড়ায় গিয়ে নামতে পারবে। কিন্তু তাকে আর নামতে দেওয়া হয়নি। যে কোনোভাবে তাকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।”

যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনা বা টেম্পু ফারদিনের বাড়ি কোনাপাড়ার পাশ দিয়েই ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু হয়ে তারাব যায়।

বিদেশ যেতে না পেরে কিংবা পরীক্ষার ফল নিয়ে ফারদিনের হতাশাগ্রস্ত হওয়ার কোনোর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তার বাবা।

এই সাংবাদিক বলেন, “অভাব, অভিযোগ, হতাশা, না পাওয়া, এরপরেও জীবন-যাপন করতে হয়- এই শিক্ষাই সন্তানকে দিয়েছি। অভাব অভিযোগ নিত্যসঙ্গী ছিল আমার, বাসা ভাড়া দিতে পারিনি। তবে অসৎভাবে চলিনি। ফলে আমার সন্তান আর যাই করুক, অন্তত আত্মহত্যা করবে না।”

সেদিন ফারদিনের শেভ করা, চুল কাটানোর তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, “আত্মহত্যার মানসিকতা থাকলে এগুলো কেন করবে? আত্মহত্যা করার আগে বোধহয় শেভ করে নিতে হয়!

“আর স্পেনে যখন যেতে পারেনি, তা হলে সেদিন সে করতে পারত।”

বিতার্কিক ফারদিনের এই ডিসেম্বরে স্পেনে এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ছিল, তার দুই মাস আগে তার মৃত্যু ঘটে।

ছেলের ‘হতাশা’র বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি বাবা হয়ে নাও জানতে পারি, কিন্তু মা অন্তত জানবেন ছেলের কতটুকু হতাশা আছে। কাল যখন বলা হল, ছেলে আত্মহত্যা করার কথা বলছে পুলিশ-র‌্যাব, তখন ফারদিনের মা আমাকে বলেছে, ‘যারা আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছে, তুমি কিছু একটা কর, না হলে আমি বাঁচব না’।”

ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের কাছে অনেক কথা বললেও এসব আপত্তির কথা ডিবিকে জানাননি নূরউদ্দিন রানা।

তিনি বলেন, “তারা অনেক কিছু দেখিয়েছেন, কোনোভাবেই মানবার মতো অবস্থা নেই। তারপরেও আমি মাথা ঝাঁকিয়েছি, মাথা নেড়েছি। তাদের ভেতরে গিয়ে তো আমি এভাবে বলতে পারি না।”

সেক্ষেত্রে কী করবেন- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি আপনাদের (সাংবাদিক) উপর ছেড়ে দিলাম। সিদ্ধান্ত আপনারাই নেবেন।”