জঙ্গি ছিনতাই: পুলিশের দুর্বলতা না অবহেলা?

জনাকীর্ণ আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দেখা দিয়েছে উদ্বেগ।

লিটন হায়দারমঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2022, 06:02 PM
Updated : 20 Nov 2022, 06:02 PM

আট বছর পর আবার ঘটল জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা, সেবার প্রিজনভ্যান থেকে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তাদের সহযোগীরা; এবার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে।

রোববার ভরদুপুরে পুরান ঢাকার জনাকীর্ণ আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের সহযোগীরা।

প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীর ভাষ্য অনুযায়ী, দুপুর ১২টার কিছুক্ষণ পর সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল শুনানি শেষে হাজতখানায় নেওয়ার সময় পুলিশের দিকে ‘স্প্রে মেরে’ তাদেরকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

পুলিশকে ছোড়া ওই স্প্রেতে কোনো রাসায়নিক ছিল বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন। তবে সেই রাসায়নিকটি কী, তা এখনও জানা যায়নি।

পুলিশ পাহারার মধ্য থেকে এভাবে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি উদ্বেগজনক বলছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে জঙ্গি তৎপরতা স্তিমিত হয়ে এলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টার কথা মাথায় রেখে পুলিশকে আরও সতর্ক হতে হত।

এই ঘটনায় নিজেদের দায় এড়িয়ে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, পুলিশের পক্ষ থেকে দুর্ধর্ষ কোনো বন্দির আদালতে নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার প্রশ্নে বাড়তি চাহিদা থাকলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানানোর সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশ তা করেনি।

সাবেক কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন বন্দিকে বুঝে নেওয়ার পর সেটা কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে চলে যায়। পরে যখন পুলিশ বুঝে নেয় সেখানে কারাগারের কোনো দায়িত্বই থাকে না।”

এদিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে আনা এই জঙ্গিদের পালানোর ঘটনায় নিজেদের কোনো দায় নেই বলে দাবি করেছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম।

তিনি বলছেন, তারা কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে ঢাকায় আদালত পুলিশের কাছে এই আসামিদের হস্তান্তর করে দিয়েছিলেন। ফলে দায় থাকলে তা আদালত পুলিশের।

ঢাকার আদালত পুলিশের কেউ এই ঘটনায় মুখ খুলছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশ এ ঘটনার তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কারও অবহেলা কিংবা গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তদন্ত কমিটি এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা গাফিলতির অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন।

“কতজন দায়িত্বে ছিলেন, কতজন দায়িত্ব পালন করেছেন, গাফলতি কার কার ছিল, নিরাপত্তা কী পরিমাণ নেওয়া হয়েছিল, অন্য কোন বিষয় আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।।”

পলাতক দুই জঙ্গিকে ধরিয়ে দিলে ১০ লাখ করে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। সারাদেশে ‘রেড অ্যালার্ট’ও জারি করা হয়েছে।

২০১৪ সালে ময়মনসিংহ থেকে আনার পথে ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা তাদের তিন নেতাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। সালাউদ্দিন সালেহীন, জাহিদুল ইসলাম (বোমারু মিজান) ও রাকিবুল হাসান নামে ওই তিনজন ছিলেন জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।

তাদের তিনজনের মধ্যে পরে রাকিবুল কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান, বোমারু মিজান সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পর ভারতে ধরা পড়েন। সালেহীন এখনও অধরা।

ওই তিনজন জেএমবির নেতা হলেও এবার যারা পালিয়েছেন, সেই মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব আরেক সংগঠন আনসার আল ইসলামের নেতা। এই দলের শীর্ষ নেতা সেনাবাহিনীর বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক দীর্ঘদিন ধরে পালিয়ে আছেন।

মইনুল ও সোহেল দুজনই প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যামামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। সোহেল লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলাতেও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত।

‘অবহেলা, চরম অপেশাদারিত্ব’

জঙ্গি ছিনতাইয়ের এই ঘটনায় পুলিশের অবহেলা ও অপেশাদারিত্ব দুটোই দেখছেন সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা দুঃখজনক ঘটনা। জঙ্গি বা দুর্ধর্ষ আসামি ট্রান্সপোর্টের জন্য যে নীতিমালা, নির্দেশনা রয়েছে, তা কয়েকবার দেওয়া হয়েছে। জঙ্গি আসামি হলে জেলে কী দায়িত্ব, কী করতে হবে; পুলিশ কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে- সব বলা আছে। 

“এখানে আমি দেখলাম, সংশ্লিষ্ট সকলের চরম অবহেলা। চরম অপেশাদারিত্ব।”

Also Read: আদালত প্রাঙ্গণে ‘পুলিশকে স্প্রে মেরে’ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনতাই

Also Read: যেভাবে ছিনতাই ২ জঙ্গি

২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী শহীদুল বলেন, “যাদের কারণে এমন অবহেলা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।”

পুলিশ ও কারা পুলিশের এক্ষেত্রে বেশ খানিকটা দুর্বলতা ছিল বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন খন্দকার ফারজানা রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমত, এক ধরনের গাফলাতি হয়েছে পুলিশের। সেখানে জেল পুলিশ বা আদালত পুলিশ, যার দায়িত্বেই থাকুক, এটা বড় ধরনের অবহেলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এদের যে নেটওয়ার্ক রয়েছে তাদেরকেও আইডেন্টিফিকেশন করা খুবই প্রয়োজন।”

প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা গেছে, দুজন দুজন করে আসামি আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল। প্রতি দুজনের সঙ্গে ছিলেন একজন পুলিশ কনস্টেবল।

আসামির পালিয়ে যাওয়ার হট্টগোলের মধ্যে জঙ্গিদের দলটির পেছনে এক পুলিশ সদস্যকেও দৌড়ে সেই লেইনে ঢুকতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। গলিতে এগিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের মারধরের শিকার হয়ে রক্তাক্ত সেই পুলিশ সদস্যকে ফিরে আসতে দেখার কথাও জানান প্রত্যক্ষদর্শী এক দোকানি।

ফাঁসির এ আসামিদের আদালতে নেওয়ার সময় তাদের ডাণ্ডাবেড়ি না থাকার কথাও উঠছে। তবে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল বলেছেন, কারাগার থেকে আসামি আদালতে পাঠানোর সময় ডাণ্ডাবেড়ি না পড়াতে আদালতের নির্দেশনা থাকায় তাদের তা পরানো হয়নি।

একই কথা বলেন কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমানও। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা কোনো আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরান না।

সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা বলেন, এই ধরনের আসামির ক্ষেত্রে যতটা পাহারার দরকার ছিল, এক্ষেত্রে ঘাটতি দেখছেন তিনি।

তিনি বলেন, “জঙ্গি দলগুলোর ভেতরে যারা এ ধরনের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে, তারা জন্য সব সময়ই এক ধরনের এক্সট্রা অর্ডিনারি সার্ভিলেন্স থাকা উচিৎ পুলিশের।”

তার মতে, ইদানিং আবার জঙ্গি সংগঠনের মাথাচাড়া দেওয়ার ইঙ্গিত মিলছিল, আবার সামনের বছর নির্বাচন রয়েছে, এসব মিলিয়ে পুলিশের যতটুকু সজাগ থাকার দরকার ছিল, সেখানে ঘাটতি ছিল।

‘গোয়েন্দা তথ্যে ঘাটতি’

জঙ্গিদের পালানোর এই ঘটনায় গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি ছিল বলেও মনে করেন সাবেক আিইজপি শহীদুল হক এবং অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক ফারজানা।

শহীদুল হক বলেন, “পুলিশকে আরও প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরও তৎপর হতে হবে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ‘নিউক্লিয়াস বডি’র মতো বিশেষ টিম করতে হবে। এটা রুটিন কাজে নিয়ে গেলে বা গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দিলে হবে না।”

তথ্য পেতে পুলিশের জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “পুলিশকে আস্থায় না পেলে মানুষও তথ্য দেবে না। কমিউনিটি পুলিশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আরও বাড়াতে হবে।”

জঙ্গিবাদ নির্মূলের আত্মপ্রসাদে না ভোগার পরামর্শ দিয়ে সাবেক এই পুলিশ প্রধান বলেন, “জঙ্গিদের অনুসারী রয়েছে। তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব রয়েছে। ওরা একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি।

“এখন জঙ্গিরা তো (মাথাচাড়া দেওয়ার) চেষ্টা করছে। কোর্টের হাজার মানুষের সামনে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তারা জানান দিচ্ছে যে তারা আছে।”

ফারজানা রহমানও বলেন, “জঙ্গিবাদটা তো একটা আইডিয়লজি। জঙ্গিবাদ কিছু সময়ের জন্য হয়ত তাদের সক্ষমতা নষ্ট করা যায়। তবে জঙ্গিবাদ যেহেতু আইডিয়লজি, এটা স্প্রেড করা অনেক সহজ।

“যেহেতু অনলাইনে তাদের রিক্রুটমেন্ট চলছে, আমরা দেখছি- গত জুলাই অগাস্ট থেকে অনেক তরুণ নিঁখোঁজ হয়েছে। একই সঙ্গে দেখছি-সামনে নির্বাচনের সময়ও আসছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে-বাংলাদেশের দেশপ্রেম বা দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে তারা এ সময়টি ও এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে কিছুটা হলে দেশের পরিস্থিতি, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করার জন্যে এক ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।”

তিনি বলেন, “যখন তারা পালাচ্ছে, এরকম না যে তারা নিজে পালিয়ে হারিয়ে গেল। এদেরকে পালানোর ক্ষেত্রে একটা নেটওয়ার্ক কাজ করে। আমি মনে করি, যারা এদেরকে হেলপ করেছে, তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব পুলিশের।”

“যাদের কারণে এমন হল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে,” বলেন শহীদুল।