যেভাবে ছিনতাই ২ জঙ্গি

ঢাকার আদালত ফটকে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন দুই জঙ্গির সহযোগীরা; চেষ্টা হয়েছিল আরও দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিতে।

কামাল তালুকদারজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2022, 02:44 PM
Updated : 20 Nov 2022, 02:44 PM

ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হাজিরা শেষে দুই জঙ্গিকে স্বল্প দূরত্বের আরেক ভবনে স্থাপিত হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল হাঁটিয়ে, সঙ্গে ছিলেন এক পুলিশ সদস্য। তারা আদালতের মূল ফটকে পৌঁছাতেই আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা জঙ্গিদের সহযোগীরা পুলিশ সদস্যের মুখে স্প্রে করে, আক্রমণ চালায়।

হঠাৎ আক্রমণে ওই পুলিশ সদস্য 'অজ্ঞান' হয়ে গেলে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই জঙ্গিকে নিয়ে সঙ্গীরা ফটক পেরিয়ে জনসন রোডে নেমে পড়ে।

দৌড়ে সড়ক পার হয়ে তারা আদালতের উল্টো দিকের গলি রঘুনাথ দাস লেইনে ঢুকে যায়।

রোববার দুপুরে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার সময় সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্য নূরে আজাদের মুখে রাসায়নিক কিছু স্প্রে করা ছাড়াও মারধর করা হয়। জঙ্গিদের সহযোগীরা তাকে মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করায় তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। এসময় একই মামলায় অন্য আসামিদেরও হাজত খানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন আরও পুলিশ সদস্য।

গোয়েন্দাদের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দুজন দুজন করে আসামিকে আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল। প্রতি দুইজনের সঙ্গে ছিলেন একজন পুলিশ কনস্টেবল।

আসামির পালিয়ে যাওয়ার হট্টগোলের মধ্যে জঙ্গিদের দলটির পেছনে এক পুলিশ সদস্যকেও দৌড়ে সেই লেইনে ঢুকতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। গলিতে এগিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের মারধরের শিকার হয়ে রক্তাক্ত সেই পুলিশ সদস্যকে ফিরে আসতে দেখার কথাও জানান প্রত্যক্ষদর্শী এক দোকানদার।

ঘটনার পর পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,  আদালত চত্বর থেকে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবকে একটি মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে।

দুই জঙ্গিসহ একটি মোটরসাইকেলে তিনজনকে ওই সময় নাসির উদ্দিন সরদার লেইন দিয়ে চলে যাওয়ার একটি ভিডিও দেখা গেছে সংবাদমাধ্যমে।

পুলিশের বিশেষ ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) সেই ভিডিও বিশ্লেষণ করছেন। আদালতের মূল ফটকের উল্টোদিকের সরু রঘুদাস লেইন গিয়ে মিশেছে নাসিরউদ্দিন সরদার লেইন।

যে সরু গলি ধরে পালিয়ে যায় জঙ্গিরা সেই রঘুনাথ দাস লেইনের শেষ মাথায় রায়সাহেব বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ফুটেজে দেখা যায় একটি মোটরসাইকেলে তিনজন অর্থাৎ ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি আর চালক ওই মোটরসাইকেল ব্যবহার করে পালিয়ে যায়। এসময় মোটরসাইকেলের আশপাশে আরও কয়েকজনকে দেখা গেছে।

তিনি জানান, রঘুনাথ দাস লেইনের কাছে আরেকটি মোটরসাইকেল রেখে পালিয়ে যায় জঙ্গিরা।

ওই কর্মকর্তা জানান, ঢাকা মেট্রো ল ৩১-৫৭১০ নম্বরের মোটরসাইকেলটি রেখে গেছে জঙ্গিরা আর সাইকেলটির নম্বর ধরে সার্চ করলে নিবন্ধনে হাসান আল মামুন এর নাম আসে। ঠিকানা হিসেবে ফায়দাবাদ ব্যবহার করা হয়েচে। মোবাইল নম্বর থাকলেও জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যায়নি।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সেসময় মইনুল হাসান ও আবু সিদ্দিকের সঙ্গে আরাফাত রহমান ও সবুর নামে আরও দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হলেও সফল হতে পারেননি জঙ্গিরা।

ঢাকা সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির জানান, মোহাম্মদপুর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলায় শুনানির জন্য তাদেরকে হাজির করা হয়।

এ মামলায় রোববার ১২ জন আসামিকে আদালতে তোলা হয়েছিল। দিনের শুনানি শেষে তাদের ট্রাইব্যুনাল থেকে হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল; যাদের মধ্যে এ মামলার আরও দুই আসামি দীপন হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ এবং অভিজিত হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস ছিলেন। তাদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হলেও তাতে সফল হননি জঙ্গিরা।

ট্রাইব্যুনাল থেকে যে পথে হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল সেটির দূরত্ব ৫০ গজের মত।

দুই জঙ্গিকে নিয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের ফটকের সামনে আসতেই ঘটে হামলার এ ঘটনা। সিটিটিসির ওই কর্মকর্তা জানান, সেখানেই ওঁত পেতে ছিল সহযোগীরা। আগে থেকে পরিকল্পনা করেই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে জঙ্গিকে।

তাদের সঙ্গে কারা ছিল তা বুঝতে আরও কিছু সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

রঘুনাথ দাস লেইনের পথটুকু দৌড়ে এসে নাসিরউদ্দিন সরদার লেইনের সড়ক ধরেই মোটরসাইকেলে তারা পালিয়ে যায়। এ সড়কের একটু দূরেই ধোলাইখাল,  সেপথ ধরেই জঙ্গিরা পালিয়ে যায় বলে ধারণা গোয়েন্দাদের।

আদালত প্রাঙ্গণের উল্টো দিকে রঘুনাথ লেইনের জাকির ফার্মেসির কর্মচারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দোকানের সামনে দিয়ে ৭/৮ জন দৌড়ে যেতে দেখেছেন এবং তাদের পেছনে এক পুলিশ সদস্যকে রক্তাক্ত অবস্থায় যেতে দেখলেও কিছুক্ষণ পর সেই পুলিশ সদস্য ফিরে আসেন।

এ লেইনের নাজমুল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের শিক্ষানবিশ আইনজীবী রাব্বুল ইসলামও বেশ কয়েকজনকে দৌড়ে যেতে দেখার কথা জানান। তখন ঘটনা বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরেছেন, সেসব যুবক পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি ছিল।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এদিন বিকালে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে এবং এঘটনায় দুজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

যাদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাদেরকে ধরতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে।

আদালতের নিরাপত্তার ঘাটতি নিয়ে আসাদুজ্জামান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জাকির নিরাপত্তা আরও জোরদার থাকা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন।

দুপুরের এ ঘটনার পর ছিনিয়ে নেওয়া দুই আসামির খোঁজে মাঠে নেমেছে পুলিশ, ঘোষণা করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। সবার সহায়তা চেয়ে দুই জঙ্গিকে ধরতে ১০ লাখ টাকা করে পুরস্কারের ঘোষণা এসেছে পুলিশ প্রধানের কাছ থেকে।

দণ্ডিত ওই দুই জঙ্গি হলেন মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব।

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) এ দুই সদস্য দীপন হত্যায় মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলাতেও আবু সিদ্দিক সোহেলের ফাঁসির রায় হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন জানিয়েছিলেন, “তাদেরকে অন্য মামলার শুনানিতে হাজির করতে কাশিমপুর কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়েছিল।

নাকে-মুখেও আঘাত করা হয় কনস্টেবল আজাদকে

আদালতে জঙ্গিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্য নূরে আজাদকে চোখে স্প্রে করার সঙ্গে সঙ্গে মারধর করেছে জঙ্গিরা।

নাকে মুখে আঘাত নিয়ে ৩৯ বছর বয়স্ক নুরে আজাদ জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপ কমিশনার ফারুক হোসেন জানান, ডিএমপির প্রসিকিউশন রিজার্ভ ইউনিটের সদস্য কনস্টেবল আজাদকে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল থেকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে রেফার করা হয়েছে।

সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ওই হাসপাতালে জরুরি বিভাগের সামনে বসে থাকা অবস্থায় দেখা গেল আজাদকে। নাকের উপর মোটা ব্যান্ডেজ, চোখ লাল, কথা বলতে পারছেন না।

কী দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল জানতে চাইলে, হাত দিয়ে ইশারা করে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলেন।

তার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিটি জানান, স্প্রে করার পর তার নাকে ও মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়েন আজাদ। এখন তিনি চোখে ঝাপসা দেখছেন। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, ডাক্তার তাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন।

Also Read: দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছে কয়েকজন সহযোগী: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

Also Read: আদালত প্রাঙ্গণে ‘পুলিশকে স্প্রে মেরে’ মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনতাই

Also Read: দুই জঙ্গি পালানোর পর ‘রেড অ্যালার্ট’, পুরস্কার ঘোষণা

Also Read: সারাদেশে আদালতে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ

Also Read: দুই জঙ্গি পালানোর পর ‘রেড অ্যালার্ট’, পুরস্কার ঘোষণা