“সাড়ে ছয় বছর ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের কোনো উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
Published : 09 Jul 2024, 11:20 PM
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরাতে চীনের সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবার চায়নিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসাল্টেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি) চতুর্দশ জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওয়াং হুনিংয়ের নেতৃত্বে উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠকের আলোচনার বিষয় পরে ব্রিফিংয়ে তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
বাসস জানিয়েছে, সিপিপিসিসির প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার শেখ হাসিনার সঙ্গে তার অবস্থানস্থলে বৈঠক করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাড়ে ছয় বছর ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের কোনো উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সহায়তা করুন।
পরে চীনের প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এ ব্যাপারে তারা সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন।
মিয়ানমারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার আশ্বাস দেন ওয়াং হুনিং।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট।
এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর প্লাস্টিকের খুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। পরে আরও কিছু উদ্যোগের শুরু হলেও তা কাজে আসেনি।
চীনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ছাড়াও দুই দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক বিষয় যেমন- বাণিজ্য ব্যবধান কমানো, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়ানো এবং আওয়ামী লীগ ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, চীন থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে, অথচ রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা খুবই কম। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চীনকে বাংলাদেশ থেকে আমদানি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, শাকসবজি ও আম আমদানি করতে পারে চীন।
অপরদিকে সিপিপিসিসি নেতারা জানান, তারা বাংলাদেশ থেকে মানসম্পন্ন পণ্য আমদানির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।
বাংলাদেশ সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টাতেই এটি গভীর হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে চীন সফর করেন এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে ষষ্ঠবারের মত চীন সফর করছেন।
পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল এবং বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রসহ (বিআইসিসি) বেশকিছু আইকনিক প্রকল্প নির্মাণে সহায়তা করার জন্য চীন সরকারকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়েও আলোচনা হয়।
শেখ হাসিনা জানান, আওয়ামী লীগ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল তিনি চীনে পাঠাবেন। কমিউনিস্ট পার্টিকেও বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান এবং বাসসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন।
বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, আর্থিক সহায়তা সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্য নিয়ে চার দিনের সফরে সোমবার চীনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেইজিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার সকালে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিন লিকুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
এদিন সাং-গ্রি-লা সার্কেলে বাণিজ্য, ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ দেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য চীনা ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান।
বিকালে ঐতিহ্যবাহী তিয়েনআনমেন স্কয়ারে চীনের বিপ্লবী বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী। সফরসূচি অনুযায়ী বুধবার চীনের স্টেট কাউন্সিলের প্রধান লি চিয়াংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। সেখানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলসহ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন।
এরপর শেখ হাসিনা ও লি চিয়াংয়ের উপস্থিতিতে ২০টির মত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে এবং কিছু প্রকল্প উদ্বোধনের ঘোষণা দেওয়ার কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ভোজের মধ্য দিয়ে গ্রেট হলে ওই সাক্ষাতের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে।
পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী, সফর শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফেরার কথা ছিল সরকারপ্রধানের। তবে তিনি বুধবার রাতেই ফিরে আসছেন বলে তার প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খান জানিয়েছেন।