সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে অন্তর্বর্তী সরকারে আসা দুই উপদেষ্টাকে সামনে পেয়ে ছেলে নাঈমকে হারানোর বেদনা এভাবেই তুলে ধরেন তার মা।
Published : 20 Aug 2024, 12:36 AM
দিনটা ছিল ৪ অগাস্ট। বাবার কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে পতাকা কিনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাঠে যায় গোলাম নাফিজ। ’ছাত্রহত্যার’ প্রতিবাদের এ আন্দোলনে তার যাওয়ার কথা জানত পরিবার। তবে এটাই যে শেষ যাওয়া তা কী আর জানতেন তারা।
ওই দিনের আন্দোলনও সহিংস হয়ে উঠলে ফার্মগেইট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির এই ছাত্র।
রাজধানীর থানায় থানায় আর হাসপাতালের মর্গে মর্গে প্রায় ২৪ ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর পরদিন বিকাল ৪টার দিকে নাফিজের লাশ মেলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে।
নাফিজকে হারিয়ে তার মা নাজমা আক্তার নাসিমার বিলাপ এখনও থামছেই না; ছোট নাফিজ যে এত বড় হয়ে গেছে, তা ছেলের লাশ দেখার পর বুঝতে পারার কথা বলছেন তিনি।
সোমবার রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই উপদেষ্টাকে সামনে পেয়ে ছেলের বড় হয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে নাসিমা বলছিলেন, “খাটিয়ায় রাখার পর বুঝতে পারলাম, আমার নাফিজ এত বড় হয়ে গেছে।”
মহাখালীতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে চিপা গলি ধরে যেতে হয় নাফিজদের বাসায়। দোতলার ছোট বাসায় দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন লিটন-নাসিমা দম্পতি।
সোমবার রাত ৮টার পর ওই বাসায় যান ছাত্র আন্দোলন থেকে অন্তর্বর্তী সরকারে আসা ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন তারই সতীর্থ যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
দুই উপদেষ্টার কাছে মর্মান্তিকভাবে ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন নাফিজের বাবা ও মা।
৪ অগাস্ট বিকাল ৩টার দিকে মায়ের সঙ্গে নাফিজের সর্বশেষ কথোপকথন তুলে ধরে লিটন বলেন, “আরেকজনের ফোনে যোগাযোগ করে। তখন বলে এনটিভির সামনে আছে, ফার্মগেইটের দিকে যাচ্ছি।
“ওর আম্মু জানতে চায়, ‘আব্বু তুমি কি আইসা পড়তেছো?’ তখন বললো, আম্মু আমি শেষ হলে আইসা পড়তেছি। এই পর্যন্ত সর্বশেষ কথা।”
এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে মোটরসাইকেলে বের হয়ে পড়েন লিটন। বিজয় সরণি মোড়ে থেকে অনেক বাধা-ব্যারিকেড পেরিয়ে ফার্মগেইট, কারওয়ান বাজার এলাকায় খুঁজে আবারও বিজয় সরণির দিকে আসেন।
পথে খোঁজ না পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে খোঁজ করতে যাওয়ার কথা বলেন লিটন। সেদিন রাত ১১টা পর্যন্ত সিআইডি, ডিবি কার্যালয়, তেজগাঁও, শাহবাগ, কলাবাগান ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলসহ বিভিন্ন থানায় গেলেও কোনো হদিস মেলেনি নাফিজের।
রাত ১২টার বাজলে দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার অনলাইনে রিকশায় থাকা একজনের একটি ছবি আছে, যাতে দেখা যায় একদিকে মাথা ঝুলছে, আরেকদিকে পা; তখনও হাতল ধরে আছে হাত।
নাফিজের বাবা বলেন, “পতাকা, পোশাক আশাক সব দেখে মনে হয়, আমার ছেলেটা মারা গেছে। এটা দেখে আমার মনে হয়েছে, এটাই মনে হচ্ছে, আমার জীবনের সব শেষ।”
পরদিন হাসপাতালে লাশের খোঁজ করতে থাকেন লিটন এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ না পেয়ে কারওয়ান বাজারে মানবজমিন অফিসের পথ ধরেন লিটন।
বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে লিটন যখন মানবজমিন পত্রিকা কার্যালয়ের ভবনের সিঁড়িতে, ভায়রার কাছ থেকে খবর পান নাফিজের লাশের সন্ধান মিলেছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে।
লাশের অবস্থা থেকে নিজেকে ধরে রাখতে না পারলেও শেষবিদায়ের স্বার্থে ‘শক্ত’ হওয়ার চেষ্টা করার কথা বলেন লিটন।
তিনি বলেন, “গুলি করছে, মাংস বের হয়ে গেছে। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আল্লাহকে বললাম, আল্লাহ আমাকে শক্তি দাও, যাতে আমি সামনের কাজটা শেষ করতে পারি।
লাশ গোসল করানোর সময় ছেলের রক্ত ঝরার কথা তুলে ধরে লিটন বলেন, “গোসল করানোর সময় দেখি যে, এত রক্ত পড়তেছে, বন্ধ করা যাচ্ছে না। গোসল করানোর সাদা কাপড় দিয়ে বেঁধে গোসল শেষ করি, রক্ত পড়ছে। কাফনের কাপড় পরাই।
“এরপর লাশ নিয়ে নিজের কাঁধে করে আমার ছেলের লাশ নিয়ে শোয়াই। এটা যে একজন পিতার কত যন্ত্রণা, কত জ্বালা, কত যন্ত্রণা- সেই বুঝে।”
পরে মানবজমিনের ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের কাছ থেকে ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার একটা বর্ণনা পাওয়ার কথা বলেন নাফিজের বাবা।
জীবনের বরাতে তিনি বলেন, “জীবন আহমেদের সঙ্গে কথা বলি। উনি বলেছেন, ‘আপনার ছেলে যখন পুলিশ চেকপোস্টের সামনে আমাদেরকে পুলিশ ঢুকতে দিচ্ছিল না।
“আমি অনেক চেষ্টা করছি, পুলিশরে অনেক অনুরোধ করছি, কিন্তু ছাত্রলীগের ছেলেপেলে যখন বসা অবস্থায় জীবিত, তখন আল-রাজী হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু ছাত্রলীগের পোলাপান ও পুলিশ ভাইয়েরা ওরে ঢুকতে দেয় নাই।’ তখন এক পুলিশ অফিসার না কি বলছে, একটা গুলি করছে মরে নাই, আরও দুইটা গুলি কর।”
তিনি বলেন, “একটা স্বাধীন বাংলাদেশে একটা ছেলেকে একটা বাড়িই যথেষ্ট, একটা গুলি করছে বের হয়ে গেছে, আরও গুলি করবে- আমরা কোন বাংলাদেশে বসবাস করি।”
নাফিজকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে তার নামে ‘গোলচক্কর’ করার দাবি জানান লিটন। মামলা করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি মামলা করব, আমাদের যে উপদেষ্টারা আসছে, আমি তাদের কাছে বিচার চাই। সুষ্ঠু বিচারের জন্য তাদেরকে পাশে চাই।”
নাফিজের মা নাসিমা সাংবাদিকদের বলেন, “এই হত্যাকারীদের বিচার চাই আমি। আমার মত জানি এই বাংলার বুকে কোনো মায়ের বুক যেন, নিজের দেশের জন্য, নিজের দেশে বুক খালি না হয়। এটা আমার দেশবাসীর কাছে দাবি।
“আমরা, সাঈদের মারা বুঝতাছি, সন্তান হারাবার ব্যথা কী রকম। এবং সন্তানগুলো হসপিটালে পড়ে আছে, ওদের বাবা-মাদেরও আমার মত কষ্ট। আমি চাইব, এই বাংলার সকলের কাছে, ওই হসপিটালের বাচ্চাদেরকে সুস্থ করে তাদের মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেয়। কোনো অবহেলা না করে।”
উপদেষ্টাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “এমন মর্যাদার দৃষ্টান্ত আপনারা রাখবেন, আরেকজন এসে মুইছা ফালাবে, এটা যেন না হয়। ওরা নিজের দেশের সাথে নিজেরা যুদ্ধ করছে, মুক্ত বাতাস আমাদেরকে দিয়ে গেছে। এই রকম যাতে না হয়, আরেক সরকার আসলে এর অস্তিত্ব থাকবে না।”
পরে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা দেখেছি, নাফিজের নিথর দেহ যেভাবে রিকশায় শুয়েছিল, এই যে নির্মমতা, সেটা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।
“পুরো পৃথিবী দেখেছে, বাংলাদেশে ছাত্রদের ওপর, নাগরিকদের ওপর কি ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। কত মায়ের বুক খালি করা হয়েছে। নাফিজ একাদশ শ্রেণির একজন ছাত্র, কলেজ শিক্ষার্থী। তার একটা সুন্দর জীবন ছিল, ভবিষ্যৎ ছিল। তার সেই ভবিষ্যৎকে বিসর্জন সে দিয়েছে। বাংলাদেশর একটা নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করার জন্য।”
তিনি বলেন, “আমরা যাতে নাফিজের আত্মত্যাগ সেটাকে কখনো না ভুলি। শহীদের এই রক্তের প্রতি আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবং আমরা নাফিজের পরিবারের সাথে সবসময় থাকব।”
‘শেখ হাসিনাকেও দেশের মাটিতে এনে বিচার করা হবে’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম বলেন, “এই হত্যাযজ্ঞের সাথে যারা জড়িত, এই গণহত্যার সাথে যারা জড়িত অবশ্যই তাদের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে।
“ইতোমধ্যে যারা এটার সাথে জড়িত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাদের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। খুবই দ্রুত সময়ের মধ্যে, যারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে আছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে। এবং যিনি এই হুকুমের আসামি, রক্তপিপাসু শেখ হাসিনা, যিনি এখন পালিয়ে আছেন, তাকেও বাংলাদেশের মাটিতে এনে বিচারের আওতায় আনা হবে।“
বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এই বিচারের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে আমাদের আইন উপদেষ্টা বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কথা বলেছেন। এবং আমরা এর থেকেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, সেটাও ভাবছি।
”এবং শেখ হাসিনাকেও দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছি। যারা ফ্যাসিস্ট, যারা স্বৈরাচারি, এই হত্যাযজ্ঞ যারা চালিয়েছে, যারা নির্দেশ দিয়েছে এবং যারা এটা বাস্তবায়নের সাথে সাথে জড়িত, তাদের সকলকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় নিয়ে আসব।”
১৪ দলের সভায় আন্দোলন দমানোর সিদ্ধান্ত হয়, তাদের বিচারের বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা করছেন কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “যারা এই হত্যার সাথে জড়িত ছিল, নির্দেশদাতা হিসাবে জড়িত ছিল, তাদের সকলের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিব।
“এবং আমরা কিন্তু বলেছি, এই যে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বর্তমান বাংলাদেশ সেখানে যারা ফ্যাসিস্ট এবং ফ্যাসিস্টদের সাথে দোসর হিসাবে, সমর্থক হিসাবে কাজ করেছে, তাদের কাউকে কিন্তু ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের সকলকে কিন্তু বিচারের আওতায় আনা হবে।”