“ঢাকায় শিবির প্ল্যান করে এটা (নাশকতা) করেছে; শিবির কর্মীরা এলাকায় নাই, সব ঢাকায় এনেছে। বিএনপি তাদের মদদ দিচ্ছে,” বলেন সরকারপ্রধান।
Published : 22 Jul 2024, 04:46 PM
দেশে নজিরবিহীন নৈরাজ্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।
তারা বলেছেন, সংকটময় পরিস্থিতিতে অতীতেও তারা প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন, এখন আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।
আর ব্যবসায়ীরা যাতে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারেন, সেজন্য সব ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা গত কয়েকদিনে ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ড চালিয়ে দেশের ক্ষতি করেছে, এবার তাদের ‘সহজে ছাড় দেওয়া হবে না’।
সোমবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ বৈঠকে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, “সব ক্রাইসিস আপনি (প্রধানমন্ত্রী) মোকাবেলা করেছেন, এই ক্রাইসিসও মোকাবেলা করবেন; আপনি ছাড়া এই বাংলাদেশে আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নাই। যা যা করণীয় আপনি করবেন, আমরা আপনার সাথে আছি।”
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত কয়েকদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে যেসব নাশকতার ঘটনা ঘটেছে, তার প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয় অনুষ্ঠানের শুরুতে।
বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে ধ্বংস করতে পারে, ভাবতেই পারি না। বিএনপি-জামায়াত সারা দেশ থেকে সন্ত্রাসীদের ঢাকায় এনে যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশটা ধ্বংস করা, বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যা করা। আপনার সাথে আমরা আছি।”
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রী আপনার সাথে ছিলাম, আপনার সাথে আছি, আপনার সাথে থাকব। তারা চায়, এ দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে। আপনার নেতৃত্বেই এ দেশ চলবে, অন্য কাউকে আমরা এখানে দেখতে চাই না, কারণ আপনি ব্যবসাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী।
“আমরা প্রত্যেকটা ব্যবসায়ী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আছি। এর কোনো বিকল্প আমরা চাই না। যারা আমার দেশকে পুড়িয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনেন।”
বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, “যে তাণ্ডব আমরা গত কয়েক দিনে দেখেছি, আমরা আশা করব, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য যারা আছেন, তারা উদযাঘটন করবেন এবং আইনের আওতায় আনবেন।
“ব্যবসায়ী সমাজ আপনার পাশে ছিল, থাকবে।”
হাতেম বলেন, “দুটো অনুরোধ। কারখানাগুলো যদি আমরা চালু রাখতে পারি, তাহলে শ্রমিকরা ভেতরে সুশৃঙ্খল পরিবেশে থাকবে। বাইরে থাকলে তাদের অন্যরা ব্যবহার করতে পারে, তাদের ভেতরে থাকাটাই নিরাপদ।
“ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। স্বল্প পরিসরে হলেও ইন্টারনেটটা যাতে চালু করা যায়।”
এপেক্স গ্রুপের নাসিম মঞ্জুর বলেন, “কারখানাগুলো কালকে থেকে খোলার ব্যবস্থা করে দেন। সমস্যা হলে বন্ধ করে দেব। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নিরাপত্তা দেন। ম্যানুয়াল সিস্টেমে মাল খালাস করার ব্যবস্থা করে দেন।
“যারা এসব করেছে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসেন। ইন্টেলিজেন্স কেন- এই তথ্যগুলো দেয়নি আপনাকে, সেটা জানতে চান। ইমেইল করার ব্যবস্থা করে দেন, নাহলে কোনো অর্ডার আমাদের থাকবে না।”
সরকারপ্রধানের উদ্দেশে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যা কিছু ঘটে গেছে, অত্যন্ত লজ্জাস্কর।
“প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাই ছিল উদ্দেশ্য; নাহলে এত অল্প সময়ে এরকম অর্গানাইজড অ্যাটাক...আপনার সাথে আমরা ছিলাম, আমরা আছি।”
সাম্প্রতিক নাশকতায় বিএনপি-জামায়াত জড়িত মন্তব্য করে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমদ আকবর সোবহান বলেন, “বিএনপি-জামাতের আগের ঘটনার বিচার হলে- আজকে তারা সাহস পেত না। সবাই জানে- কারা কারা এর সাথে জড়িত।
“আমাদের সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে; আপনারা চিন্তা করেন- ১৪ বছর আগে আপনারা কোথায় ছিলেন, এখন কোথায় এসেছেন। ৭ দিন ব্যবসা বন্ধ থাকলে কিছু হবে না। এই সন্ত্রাসী জঙ্গিবাহিনীকে ধ্বংস করতে হবে, সেজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
আগুন সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “উনি আমাদের নেতৃত্বে দেবেন, ইনশাল্লাহ কোনো শক্তি আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। নেতৃত্বের প্রতি আমাদের আস্থা-বিশ্বাস আছে, মৃত্যুর পরও আস্থা-বিশ্বাস থাকবে।”
প্রাণ গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, “আমরা যদি সকলে মিলে কাজ করি, ভুল বোঝাবুঝি না থাকে, তাহলে পিছপা হতে হবে না।”
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারিখাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, যারা স্বাধীনতা বিশ্বাস করে না, তারাই গত কয়েকদিন নাশকতা করেছে। শিগগিরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতায় গত কয়েকদিনে সার্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে রামপুরায় বিটিভি ভবন, মহাখালীর সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, মিরপুরে মেট্রোরেল স্টেশনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
গত রোববার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা নিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে দেয়। সেই সঙ্গে সরকারি চাকরির কোটার নতুন বিন্যাস ঠিক করে সরকারকে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়।
তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, “ছাত্ররা যা চেয়েছে, সরকারও তাই করেছে। তার পরও পরিস্থিতি কেন এ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল?
“যখন অগ্নিসন্ত্রাস ও জঙ্গি আক্রমণ শুরু হল, তখন বোঝা গেল তৃতীয় পক্ষ এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে।… কারা তাদের হাতিয়ার করেছে? জামায়াত এবং শিবির। তাদেরকে দমনের জন্য আমাদের শক্ত হতে হয়েছে।”
তিনি বলেন, “যেসব পত্রপত্রিকা হতাহতের খবর দিচ্ছে, তাদের অনুরোধ করব, আপনারা আক্রমণকারীদের দায় দিন। পুলিশকে হত্যা করে বাঁশের মধ্যে ঝুলিয়ে রেখেছে যিশু খ্রিস্টের মতন, এটা কি সাধারণ ছাত্ররা করতে পারে?
“প্রতিটি ঘটনার মধ্যে জঙ্গি সিগনেচার আছে। প্রতিটা পরিকল্পনা তারা করেছে। জামায়াত-শিবির-বিএনপি-জঙ্গিরা এর জন্য দায়ী; এই ধরনের প্রমাণও পাওয়া গেছে, তাদের অনেকে ড্রাগড।”
‘এবার অত সহজে ছাড়া হবে না’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা বলেছি, হতাশ হবে না। তারপরও এই আন্দোলটা চালিয়ে যাওয়া…যখন বাংলাদেশটাকে আমরা একটা জায়গায় নিয়ে আসলাম, আঘাত আসল। কোন উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে? এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কী উদ্দেশ্যে করা?
“আমি খবর পেলাম, এখন যদি বন্ধ করা না হয়, তারা আগুন দেবে; আর্মি নামাতে আমি বাধ্য হয়েছি, আর্মি নামিয়েছি, কারফিউ দিয়েছি।”
সরকারপ্রধান বলেন, “কিন্তু এরা কারা? অপরিচিত কেউ না। তারেক জিয়া ওখান থেকে হুকুম দেয়, ‘এটা জ্বালাও, ওটা জ্বালাও’। এই বিএনপি, জামায়াত, শিবির একসাথে করেছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করতে দিয়েছি, সব রকমের সুযোগ দিয়েছি, কোন দল করে- সেটা দেখিনি। প্রতিটা নির্বাচনের আগে আপনারা আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। কারফিউ দিতে চাইনি, বাধ্য হয়েছি দিতে- মানুষের জানমাল রক্ষা করার জন্য।”
তিনি বলেন, “আমি জানি, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে হবে। সেজন্যই আপনাদের ডেকেছি। কারণ, সেজন্য আপনাদের সহযোগিতা দরকার।”
কারখানা খুলে দিতে ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আপনারা যদি মনে করেন, কারখানা আপনারা রক্ষা করতে পারবেন, তাহলে খুলে ফেলেন। কিন্তু যদি কিছু ঘটে- তার দায় দায়িত্ব আপনাদের। আমাকে দায়ী করতে পারবেন না। গোয়েন্দা তথ্য আছে বলেই আমি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি।”
সাম্প্রতিক সহিংসতার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে যে গুজব রটে, সেই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “শেখ হাসিনা পালায় না। আমার ফ্রান্সে যাওয়ার কথা, ব্রাজিলের যাওয়ার কথা, আমি ক্যানসেল করে দিয়েছি।
“আগুন যারা দিল, যারা পোড়াল, তাদের বিরুদ্ধেই আপনাদের কথা বলতে হবে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “এখানে শিবির প্ল্যান করে এটা করেছে; জেলায় জেলায় খবর নিয়েছি, শিবির কর্মীরা এলাকায় নাই, সব ঢাকায় এনেছে। বিএনপি তাদের মদদ দিচ্ছে।
“কারফিউ কিছু শিথিল করেছি আজকে; যেসব জেলার পরিস্থিতি ভালো হবে, ডিসিদের দায়িত্ব দিয়েছি- ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যাবে।”
২০১৩-১৪ সালের আগুন সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আগের ঘটনার বিচার হয়েছে…কিন্তু বের হয়ে এসে আবার একই চেহারা। এবার তাদের অতো সহজে ছাড় দেওয়া হবে না।”
তিনি বলেন, “জঙ্গিদের দমন করা, মানবিক পরিবেশ সৃষ্টি করা-এটাই আমাদের লক্ষ্য। আরো শক্ত অ্যাকশন নিয়ে এদের দমন করে আমরা পরিস্থিতির উন্নতি করব।”