ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থেকে তদুর্ধ্ব কমিশন পাওয়া কর্মকর্তাদের এবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
Published : 16 Nov 2024, 07:58 PM
সরকার বদলের প্রেক্ষাপটে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা আরও দুই মাস বাড়ানো হয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রথম দফায় বিশেষ এ ক্ষমতা দেওয়ার নির্ধারিত দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার আগে শুক্রবার সময় বাড়ানোর আদেশ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। শনিবার এ প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বিশেষ এ ক্ষমতার আওতায় গ্রেপ্তার ও বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার মত সুযোগ থাকছে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থেকে তদুর্ধ্ব কমিশন পাওয়া কর্মকর্তাদের।
পাশাপাশি কোস্টগার্ড ও বিজিবিতে প্রেষণে নিয়োজিত সমপর্যায়ের কর্মকর্তারাও এ ক্ষমতা পাবেন বলে সবশেষ প্রজ্ঞাপনে যুক্ত করা হয়েছে।
এসব কর্মকর্তাদের আরও ৬০ দিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপনে আগের মতই তা সারাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে বলে জানানো হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে থেকে সারাদেশে মোতায়েন ছিল সেনাবাহিনী। ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর কারফিউ তোলা হলেও বিপর্যস্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সেনা সদস্যদের মাঠ পর্যায়ে রেখে দেওয়া হয়।
পরে যৌথবাহিনী অভিযানেও নামে। তখন ১৭ সেপ্টেম্বর দুই মাসের জন্য সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়।
বর্তমানে দেশের ৬২ জেলায় সেনাসদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সহায়তা করছে বলে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের স্টাফ কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার।
এ পর্যন্ত আড়াই হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার এবং ছয় হাজারের বেশি অস্ত্র, দুই লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধারের তথ্য দেন তিনি।
এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।
এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর আগের প্রজ্ঞাপনে সংশোধন এনে 'সেনাবাহিনী'র জায়গায় 'সশস্ত্র বাহিনী' যুক্ত করে সেনা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এ ক্ষমতা দেওয়া হয় নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও।
ফৌজদারি কার্যবিধির যে ১৭ নম্বর ধারায় সেনা কর্মকর্তাদেরকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই নির্বাহী হাকিমরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অর্থাৎ জেলা প্রশাসকের অধীনে থাকার কথা বলা আছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৮৬, ৯৫(২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ এবং ১৪২ ধারার অধীনে তাদের কার্যক্রম চলার কথা বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
এসব ধারায় গ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তারের আদেশ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা, তল্লাশি পরোয়ানা জারি, অসদাচরণ ও ছোটোখাটো অপরাধের জন্য মুচলেকা আদায়, মুচলেকা থেকে অব্যাহতি, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার ক্ষমতা পাবেন বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
একই সঙ্গে স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাধা অপসারণ এবং জনগণের ক্ষতির আশঙ্কা করলে সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারবেন তারা।
প্রথমবার এই ক্ষমতা দেওয়ার পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান বলেছিলেন, দেশে একটি জনবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
তখন থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে যৌথ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। নিয়মিত টহল কার্যক্রমের পাশাপাশি সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাতে দেখা গেছে যৌথ বাহিনীর সদস্যদের।
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের স্টাফ কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার গত দুই মাসে সাতশর বেশি বিভিন্ন ধরনের ‘বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি’ নিয়ন্ত্রণ করেছে সেনাবাহিনী বলে তথ্য দেন।
এর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৪১টি, সরকারি সংস্থা/ অফিস সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ৮৬টি, রাজনৈতিক দলের ঘটনা ছিল ৯৮টি।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে পাওয়া ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা যেন ‘সুষ্ঠুভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে’ প্রয়োগ করা হয়, সে বিষয়ে সেনাবাহিনী সতর্ক আছে বলেও জানান তিনি।
এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী কতদিন মাঠে থাকবে, অন্তর্বর্তী সরকারই তা নির্ধারণ করবে বলে জানিয়েছেন এই সেনা কর্মকর্তা।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা বাড়তে থাকলে শেখ হাসিনার সরকার ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। এরমধ্যেই আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পরে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে, বিক্ষোভ ও সহিংসতা বাড়তে থাকে। মাসব্যাপী সেই আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। পরে ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
সরকার পতনের পর দেশজুড়ে থানায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আক্রমণের শিকার হতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। আগুন দেওয়া হয় থানা ও পুলিশের স্থাপনায়। লুট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
আন্দোলনের মধ্যে মানুষের ব্যাপক সেই ক্ষোভের সময় পুলিশের বেশির ভাগ সদস্য কাজে ফেরেননি। পরে কর্মবিরতিতে যায় পুলিশ। তাদের অনুপস্থিতিতে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে।
সরকার পতনের তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গহণ করে। নতুন সরকারের সময় কারফিউ না থাকলেও দেশজুড়ে সেনা মোতায়েন থাকে। পুলিশের অনুপস্থিতিতে শুরুর দিকে থানায় থানায় দায়িত্ব পালন করেন সেনা সদস্যরা।
পরে পুলিশ কাজে ফিরলেও অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে সামরিক সদস্যদের মধ্যে ‘কমিশন্ড’ কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজেস্টেটের ক্ষমতা আরও ৬০ দিন বাড়ানো হল।
আরও পড়ুন: