‘আদিবাসী’: বিধি-নিষেধের ‘সংবিধান পরিপন্থি’ চিঠি তুলে নিতে বিবৃতি

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আদিবাসী’ শব্দটি উল্লেখের তথ্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বিবৃতিদাতারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2022, 02:20 PM
Updated : 30 July 2022, 02:20 PM

‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিকে ‘সংবিধান পরিপন্থি’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাহার করে নিতে আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের নেতৃস্থানীয় ৫০ জন নাগরিক।

তাদের পক্ষে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা শনিবার গণমাধ্যমে এই যৌথ বিবৃতি পাঠান।

বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আদিবা্সী’ শব্দটি উল্লেখের তথ্য স্মরণ করিয়ে বিবৃতিদাতারা বলেন, এখন একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিপত্রের ভিত্তিতে এই বিবৃতিটি দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়।

গত ১৯ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের টিভি-২ শাখার উপসচিব শেখ শামছুর রহমান স্বাক্ষরিত এক সার্কুলারে বলা হয়, “বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

“এ অবস্থায় আগামী ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টক শোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্য ব্যক্তিদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।”

Also Read: ‘আদিবাসী’ শব্দে বিধিনিষেধের চিঠি নিয়ে ক্ষোভ

তাদের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ৫০ নাগরিকের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “যে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এই সার্কুলার প্রচার করেছে, সেই সরকারের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ২৮ (ক) ধারায় একাধিকবার আদিবাসী শব্দটি স্পষ্ট করে ব্যবহার করা হয়েছে।

“এই সার্কুলারটি আসলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিপত্রকে ভিত্তি করেই রচিত এবং তার অনুলিপি হিসেবেই প্রচার করা হয়েছে।”

এর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিবৃতিতে বলা হয়, “কোন শব্দটি সংবিধানসম্মত কিংবা অসাংবিধানিক, তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার গোয়েন্দা অধিদপ্তর কিংবা তথ্য মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার প্রণয়নকারীদের কাছে কখন কীভাবে গেল, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।

“গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সঙ্গে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এটি চরম অনধিকার চর্চার পর্যায়ে পড়ে, যা মোটেই কাম্য নয়, আইনসম্মতও নয়।”

‘আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারে আইনগত কোনো ‘প্রতিবন্ধকতা নেই’ দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়, “আমাদের দেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধানের কোনো ধারা বা বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্ক বা মতান্তর দেখা দিলে তার ব্যাখ্যা একমাত্র দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টই দিতে পারবেন। অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়। আর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টেরই এক রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারে আইনগত কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।”

বিবৃতিদাতারা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৭২ সালে যে আই এলও কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর করে গেছেন, সেখানেও আদিবাসী শব্দটি শুধু ব্যবহারই নয়, তাদের সকল অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া কয়েক মেয়াদে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে তার দেওয়া বাণীতে আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচয়ে সকল অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন।

“সর্বোপরি সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২(ক) ও ২(খ) ধারায় যে বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়া রয়েছে, তাতেও এই সার্কুলারে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। একজন কী শব্দ চয়ন করলেন, তাতে রাষ্ট্রের কারও কিছু বলার নাই, যদি এই শব্দ ব্যবহারে অন্য কারও প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা না ছাড়ানো হয়।”

বিবৃতিদাতারা হলেন- মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল, উন্নয়ন সংস্থা ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবির, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. হামিদা হোসেন, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের (রিব) নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত, ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ, আইনজীবী জেড আই খান পান্না, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সহ-সভাপতি তবারক হোসাইন, অধ্যাপক আবুল বারকাত, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, চাকমা রানী ইয়েন ইয়েন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, নারীপক্ষের সদস্য শিরিন হক, আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, ব্ল্যাক হিল স্টেট ইউনিভার্সিটির এমিরেটাস অধ্যাপক আহরার আহমেদ, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বীনা ডি কস্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনিম সিরাজ মাহবুব, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফেরদৌস আজীম, ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন কণা, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক নোভা আহমেদ, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী রেজাউল করিম লেনিন, সাংবাদিক ও গবেষক সায়দিয়া গুলরুখ, মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, অধিকারকর্মী হানা শামস আহমেদ, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, সঙ্গীতশিল্পী ও লেখক অরূপ রাহী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী।