“আমি আগেও যা বলেছি, এখনও বলছি যে, আইনের কিছু মিসইউজ ও অ্যাবিউজ হয়েছিল, আমি যেটাকে বলব অপব্যবহার হয়েছিল।”
Published : 02 Apr 2023, 07:27 PM
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার যে হয়েছে, সে কথা স্বীকার করে নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তারা চেষ্টা করবেন ‘বিধি’ তৈরি করে অপব্যবহারের পথ বন্ধ করতে, তাতে না হলে ‘প্রয়োজনে’ সংশোধনের কথা ভাববেন।
প্রথম আলোর সাংবাদিককে গ্রেপ্তার এবং র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ রদ করার দাবি যখন নতুন করে জোরালো হয়ে উঠেছে, সেই সময় আইনমন্ত্রীর এমন ভাষ্য এল।
রোববার মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে উপস্থিত হয়েছিলেন আইনমন্ত্রী। সেমিনারের বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে আরবিট্রেশন আইনের প্রয়োজনীয় সংষ্কার’। তবে সেমিনার শেষে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন।
উত্তরে তিনি বলেন, তিন দিন আগের সাংবাদিক আটকের ওই ঘটনায় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে নতুন করে ভাবনার ‘প্রশ্ন ওঠে না’।
“আমি আগেও যা বলেছি, এখনও বলছি যে, আইনের কিছু মিসইউজ ও অ্যাবিউজ হয়েছিল, আমি যেটাকে বলব অপব্যবহার হয়েছিল। সেটাকে আমি স্বীকার করে এটার কী পরিবর্তন আনা যায়; সেজন্য আমরা জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমশিনারের অফিসের সঙ্গে আলোচনারত।
“এখনো সে আলোচনা চলছে। সেখান থেকে একটি টেকনিক্যাল নোট এসেছে। সেটা আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি।’’
আইনমন্ত্রী বলেন, “গত ১৪ মার্চ সুধী সমাজের সঙ্গে বসেছিলাম, তাদের কথা শুনেছি। তারা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ডেটা প্রটেকশন আইন ও এনজিওদের ভলান্টারি ফান্ড নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি তাদের বলেছিলাম, আমার কথাও আছে। মধ্য এপ্রিলে সেই আলোচনাটি আবার হবে।
“ওই আলোচনা হওয়ার পর ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপব্যহারের বিষয়গুলো সংশোধন যদি বিধি দ্বারা সম্ভব হয়, তাহলে তা করব, নইলে যদি আইনের সংশোধনের প্রয়োজন হয় তাহলে সংশোধন করা হবে।”
দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি ও উদ্বেগের মধ্যে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ব্যাপক সমালোচিত ৫৭সহ কয়েকটি ধারা বাতিল করে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হলেও পুরনো আইনের বাতিল হওয়া ধারাগুলো নতুন আইনে রেখে দেওয়ায় এর অপপ্রয়োগের শঙ্কা ছিল উদ্বেগের কেন্দ্রে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালে কারাগারে মারা যাওয়ার পর ওই আইন বাতিলের দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছিল।
এরপর আইনের ‘অপব্যবহার’ বন্ধে আইনমন্ত্রীর আশ্বাসের মধ্যেও সংবাদকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার থেমে থাকেনি। সর্বশেষ ঘটল প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস এবং নওগাঁর ভূমি অফিসের কর্মী সুলতানা জেসমিনকে নিয়ে।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে কর্মরত যুগ্ম সচিব এনামুল হকের অভিযোগে গত ২২ মার্চ নওগাঁ থেকে র্যাব আটক করে ভূমি অফিসের কর্মী জেসমিনকে।
আটকের চার ঘণ্টা পর তাকে অসুস্থ অবস্থায় নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় র্যাব। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ২৪ মার্চ সেখানে তার মৃত্যু হয়।
জেসমিনকে আটকের পর তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন যুগ্মসচিব এনামুল।
সেই ঘটনা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে ওই পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক শামসকে ২৯ মার্চ ভোররাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় সিআইডি। ৩০ ঘণ্টা পর তাকে আদালতে তোলা হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবিলম্বে স্থগিত করুন: জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আবার বিতর্কে
এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন সরকার সমর্থক যুব সংগঠন যুবলীগের এক নেতা। পরে একই আইনে আরেকটি মামলায় হয়, সেখানে শামসের পাশাপাশি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকেও আসামি করা হয়।
এ ঘটনার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ করেছে বামপন্থি বিভিন্ন সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে বিক্ষোভ। জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র, আর্টিকেল নাইনটিনসহ দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও ওই আইনের বিপদ নিয়ে নতুন করে সতর্ক করেছে সরকারকে।
সাংবাদিক শামসের নিঃশর্ত মুক্তির পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানি বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।
প্যারিসভিত্তিক রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যে কোনো সমালোচনার জন্য ‘গণমাধ্যমের উপর খড়গ চালানো’ বাংলাদেশের সরকারকে বন্ধ করতে হবে।
আর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ফোলকার টুর্ক বলেছেন, “এ আইনের ব্যবহার অবিলম্বে স্থগিত করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের শর্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংস্কারের জন্য আমি আবারও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
প্রয়োজনীয় সংস্কারে সহায়তা করতে মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের দপ্তর থেকে ইতোমধ্যে বিস্তারিত মন্তব্য ও পরামর্শ দেওয়ার কথাও বিবৃতিতে বলেন টুর্ক।
আইনমন্ত্রী বলেছেন, সাংবাদিকদের যেন ওই আইনে অহেতুক হয়রানি করা না হয়, সে পদ্ধতি ইতোমধ্যে ‘গ্রহণ করা হয়েছে’।
কিন্তু তাতে যে কাজ হচ্ছে না, সে কথা তুলে ধরে গত শুক্রবারের বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান বলেছেন,
শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা অতিরিক্ত ব্যবহার যেন না হয়, তা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু গ্রেপ্তার অব্যাহত থাকায় সেই প্রতিশ্রুতি এখন আর যথেষ্ট হচ্ছে না। খোদ আইনটিরই যথাযথ সংশোধন প্রয়োজন।”
আরবিট্রেশন আইনের সংষ্কার
ডিসিসিআই আয়োজিত এই সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল আরবিট্রেশন আইনের। বক্তব্যরা সেখানে আইনি সংস্কারের পক্ষে যুক্ত তুলে ধরেন বলে ডিসিসিআই এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সেমিনারে ডিসিসিআই সভাপতি সামীর সাত্তার বলেন, একটি কার্যকর বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা দেশে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম পূর্বশর্ত।
“গত কয়েক দশকে আমাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বাণিজ্য বিরোধের পরিমাণ, ফলে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে আরবিট্রেশন একটি অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।”
গত দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হওয়ার কথা তুলে ধরে ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট ডিকসন বলেন, আগামী ৩ বছর পর এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের কারাতে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। ওেই সময়ের পরে অধিকতর বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য আরবিট্রেশন আইনের প্রয়োজনীয় সংষ্কার ‘একান্ত অপরিহার্য’।
“এটা সত্য যে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা এবং এডিআরের মাধ্যমে দ্রততম সময়ে বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি করতে চায়। বাংলাদেশের কমার্শিয়াল আইনের সংষ্কার খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।”
সেমিনারে মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আশরাফুল হাদি বলেন, আরবিট্রাল ট্রাইবুনালের কোর্টের মত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন।
তিনি স্ট্যাম্প-এর মাধ্যমে শুল্ক দেওয়ার সকল প্রক্রিয়া ডিজিটাল কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করেন এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে আরবিট্রেশন মামলার কার্যক্রমের একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেইজ তৈরির প্রস্তাব দেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ
ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি ‘স্মার্ট আরবিট্রেশন’ প্রক্রিয়া চালু করার উপর জোর দিতে আহ্বান জানান ইউনিলিভার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ আকতার।
আর গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান বলেন, আরবিট্রেশন অ্যাক্ট ২০০১ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, তবে এটার প্রয়োজনীয় সংষ্কার জরুরি। দ্রুত আইনটি বাস্তবায়নে তথ্য-প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ব্যবস্থার আওতায় আনা দরকার।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রমোদ নায়ার বলেন, আরবিট্রেশন আইনের প্রয়োজনীয় সংষ্কারের পর ব্যবসা পরিচালন সূচকে ভারতের অবস্থানের উন্নতি ছিল ‘চোখে পড়ার মত’।
তিনি জানান, বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ভারতে আলাদাভাবে ‘কমার্শিয়াল কোর্ট’ পরিচালিত হয় এবং এ ধরনের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সময়সীমা ও ফি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে।