‘শরীফার গল্প’ নিয়ে বিতর্ক সংসদে নিলেন চুন্নু

বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ বলছেন, “দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের শরীফার গল্পের মাত্র দুটি লাইন প্রত্যাহার করে নিলে আর কোনো বিতর্ক থাকে না।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2024, 03:12 PM
Updated : 4 Feb 2024, 03:12 PM

 সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘শরীফার গল্প’ থেকে দুটি লাইন প্রত্যাহারের দাবি সংসদে তুলেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

রোববার সংসদ অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “ট্রান্সজেন্ডার ধারণাটি ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের শরীফার গল্পের মাত্র দুটি লাইন প্রত্যাহার করে নিলে আর কোনো বিতর্ক থাকে না।”

বিকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রম শুরু হয়।

মাগরিবের নামাজের বিরতির পর অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ চুন্নু বলেন, “ইদানিং একটা বিষয় পত্রপত্রিকা, সোশাল মিডিয়ায় সবখানে আলোচিত হচ্ছে। সে আলোচনায় দেখা যায় অনেক সময় ভুল আলোচনা হয়, মানুষের অনুভূতিতে আঘাত আসছে। তাতে ধূম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে। সেটা হেল সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের একটি গল্প- শরীফার গল্প।”

গল্পটি পড়ে শুনিয়ে ট্রান্সজেন্ডার, তৃতীয় লিঙ্গ এবং হিজড়া- এরমধ্যে পার্থক্য নিজের মত করে তুলে ধরেন এই সংসদ সদস্য।

তিনি বলেন, “নিজেকে নিজের জন্মগত লিঙ্গ বাদে অন্য কোনো লিঙ্গ মনে করাটাই ট্রান্সজেন্ডার। এ বিষয়টা পুরো পুরি মেন্টাল। হিজড়া যারা তারা হল থার্ড জেন্ডার, সে বিষয়টা জন্মগত। এটা মানসিক, শারিরীক উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এরাই থার্ড জেন্ডার অথবা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। ট্রান্সজেন্ডার একটি শ্রেণির মতবাদ, এটা প্রবর্তিত হয়েছে গতানুগতি, সামাজিক ও ধর্মকে ধারণা অর্থাৎ পরিবার, ধর্মকে ভেঙে সামাজিক একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।”

বিরোধী দলীয় চিফ হুইপের ভাষ্য, “ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ অনুযায়ী একজন ব্যক্তি যে কোনো সময় যে কোনো লিঙ্গ হসেবে পরিচয় দিতে পারবে। আল্লাহ আমাদের কি লিঙ্গ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন সেটা তাদের কাছে কোনো বিষয়ই না। তবে পশ্চিমাদের অনেকেই এ মতবাদের বিরোধী।

“টান্সজেন্ডার ধারণাটি থার্ড জেন্ডার হিসেবে চালিয়ে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য কোনোক্রমেই ভালো বলে আমরা মনে করছি না।”

 

‘শরীফার গল্প’ নামে জনসচেতনতামূলক ওই পাঠ সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে জায়গা পেয়েছে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ বিষয়ে ধারণা দেওয়ার জন্য।

বইয়ের ৩৯ ও ৪০ নম্বর পৃষ্ঠায় অন্তর্ভুক্ত ওই পাঠে শিক্ষার্থীরা পড়বে নারী-পুরুষের বাইরে ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষ বা ‘হিজড়াদের’ জীবনের কথা। 

পাঠ্যপুস্তকটির পাঠের এ অংশ নিয়েই গত দুই সপ্তাহ ধরে তুমুল বিতর্ক চলছে দেশজুড়ে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আগে থেকেই বিভক্তরা এ প্রসঙ্গ ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আরও গরম করে তুলেছেন।

এ বিতর্কের সূচনা করেছেন আসিফ মাহতাব, যিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। রাজধানীতে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে এক আলোচনায় ‘সমকামিতার উসকানির’ অভিযোগ তুলে তিনি পাঠ্যবইয়ের ওই অংশের পাতা ছিঁড়ে ফেলেন। সেই ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

বইটি সম্পাদনার সঙ্গে যুক্তরা বলেছেন, সেখানে ‘হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষদের কথা বলা হয়েছে। আগে সেখানে ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি থাকলেও নতুন বইয়ে ওই শব্দটিই নেই, সেখানে আছে থার্ড জেন্ডার। সুতরাং এ পাঠকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ নেই।

তবে আসিফ মাহতাবের মত চুন্নুও কথা বলছেন ওই ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটিকে ভিত্তি ধরে।

সংসদে তিনি বলেন, “ট্রান্সজেন্ডার ধারণাটি ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ ইতোমধ্যে মতামত দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানরা দলীয়ভাবে ট্রান্সজেন্ডার ধারণার বিরোধী।

“আমরা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তাই বিশ্বাস করি, যারা হিজড়া তারা নিজ থেকে হিজড়া না। তারা জন্মগতভাবে হিজড়া, আল্লাহ পাক তাদের এভাবে সৃষ্টি করেছেন। এদের অধিকার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম স্বীকার করে। ইসলাম ধর্মেও এদের অধিকার সুরক্ষিত রয়েছে। এমনকি সৌদি ফতোয়া বোর্ড এদেরকে অপারেশন করে স্পেসিফিক জেন্ডারে রূপান্তরিত করাকে সহি বলে অনেক আগে মতামত দিয়েছে। হিজড়াদের নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নেই।”

এই যুক্তিতে শরীফার গল্প থেকে ‘ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলতো, কিন্তু একসময় আমি বুঝলাম আমার শরীরটা ছেলের মতো হলেও আমি মনে একজন মেয়ে’– এই লাইনটি প্রত্যাহারের দাবি জানান মুজিবুল হক চুন্নু।

তিনি বলেন, “এটা হল একটা মানসিক বিষয়। এটাকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য যেটা, এ পার্লামেন্টে বলতে চাই না, আপনিও মাননীয় স্পিকার নিজে বোঝেন। ট্রান্সজেন্ডার যেহেতু ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, পাঠ্যপুস্তক থেকে দুটি লাইন যদি প্রত্যাহার করেন, তাহলে এটা সম্পর্কে দেশের মানুষের আর কোনো অবজেকশন থাকবে না।

“শিক্ষামন্ত্রীকে বলব- এটা যেন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেন। এটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, সোশাল মিডিয়ায় কথা হচ্ছে উল্টা পাল্টা এটা সামান্য জিনিস, এটা যাতে ব্রড না হয়, প্রয়োজনে ওদেরকে ডেকে বা কনসার্ন লোকের সঙ্গে বসে এ বিষয়টা পাঠ্যপুস্তক থেকে এ দুটি লাইন প্রত্যাহার করেন, আর কোনো বিতর্ত থাকে না।”

শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এর আগে বলেছিলেন, হিজড়াদের অধিকার বাংলাদেশে আইনিভাবে স্বীকৃত। তারাও এ দেশের নাগরিক। তারপরও শরীফার পাঠ নিয়ে যদি কোনো বিষয় থাকে, সেটা পর্যালোচনা করার সুযোগ আছে। 

‘শরীফার গল্প’ পর্যালোচনায় ইতোমধ্যে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুর রশীদকে দেওয়া হয়েছে কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব।

আরও পড়ুন

Also Read: 'শরীফার গল্প' নিয়ে বিতর্ক কেন?

Also Read: বই থেকে ‘শরীফার গল্প‘ বাদ দিতে উকিল নোটিস