ভারতে থেকে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বক্তব্য ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের জন্য ‘ক্ষতিকর’ হিসেবেও বর্ণনা করেন তিনি।
Published : 24 Feb 2025, 11:19 PM
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার বিষয়ে বলতে গিয়ে ভারতবিরোধী বক্তব্যের যে উদাহরণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর টেনেছেন, সেটির জবাব দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন; প্রতিবেশী দেশটির রাজনীতিবিদদের নিয়েও পাল্টা দোষারোপ করলেন তিনি।
ভারত থেকেও বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য আসার উদাহরণ দিয়ে সোমবার তিনি বলেন, “উনাদের মুখ্যমন্ত্রী তো পারলে এখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী ফোর্স পাঠিয়ে দেয়। উনাদের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অহরহ বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
“তো, এগুলো চলতে থাকবে ধরে নিয়েই আমরা চেষ্টা করতেছি, সম্পর্ক ভালো করা যায় কি না। কাজেই, আমাদের অবস্থান সেটাই। আশপাশ থেকে দু’চারজন কী বলল না বলল সেটাতে মনোযোগ না দিয়ে আমরা বরং আমাদের সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করি।”
এদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
দুদিন আগে শনিবার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের ‘ভারতবিরোধী’ বক্তব্যকে ‘হাস্যকর’ আখ্যায়িত করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেন, বাংলাদেশকে ঠিক করতে হবে যে তারা ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়।
তিনি বলেন, "আমরা খুব স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি-আপনারা আমাদের প্রতিবেশী, আমরা চাই পরিস্থিতি শান্ত হোক, আমরা চাই বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং অন্যান্য বিষয় এগিয়ে যাক; কিন্তু যদি ক্রমাগত এমন বার্তা বা সংকেত দেওয়া হয়, যেটা ভারতের প্রতি শত্রুতামূলক, সেটা নিশ্চয় আমাদের ভালো লাগবে না।”
বাংলাদেশের দুটি বিষয় ভারতের জন্য ‘খুবই উদ্বেগজনক’ মন্তব্য করে তিনি সেদিন বলেন, "প্রথমত, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিক হামলার ঘটনা; আমি মনে করি এটা আমাদের চিন্তাভাবনার ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে এবং এটা এমন একটা বিষয়, যা নিয়ে আমাদের কথা বলা উচিত এবং আমরা তা বলছি।"
জয়শঙ্কর বলেন, "দ্বিতীয়ত, তাদের নিজেদের রাজনীতি আছে, আপনি একমত হতে পারেন বা না হতে পারেন, দিন শেষে আমরা প্রতিবেশী। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা আমাদের সাথে কেমন সম্পর্ক চায় ।
“কারণ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো সদস্য যদি প্রতিদিন উঠে দাঁড়িয়ে সবকিছুর দোষ ভারতের ওপর চাপাতে থাকেন… আর কিছু কিছু বিষয়, আপনারা যদি খবরগুলো পড়েন, সম্পূর্ণ হাস্যকর।”
তার সবগুলো বক্তব্যের জবাব দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সংখ্যালঘু ইস্যুকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখার কথা বলেন।
ভারতবিরোধী বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, “ভারত কেমন সম্পর্ক চায়, সেটা তো তারা সিদ্ধান্ত নেবে। তবে উনি কিছু বলেছেন যে, বাংলাদেশের বিভিন্নজন বিভিন্ন আপত্তিকর কথা বলছে, সরকারের ভেতর থেকে, ভারতবিরোধী।
“আমি এটার ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বিচার করতে চাই না। কিন্তু আমার কথা হল যে, এ রকম কথা আমাদের এখান থেকেও বলতেছে, ওনাদের ওখান থেকেও বলছে।”
অন্যদের সঙ্গে কে কেমন সম্পর্ক চায়, সেটা নির্দিষ্ট দেশের সিদ্ধান্ত হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “উনি বলেছেন যে, কেমন সম্পর্ক চায় বাংলাদেশ, সেটা বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই না?
“অবশ্যই, বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেবে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়। একইভাবে ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়। এটা দুই পক্ষেরই বিষয় এবং এই বলাতে দোষের কিছু নাই।”
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আমার তো মনে হয়, আমাদের খুব স্পষ্ট সিদ্ধান্ত আছে এ ব্যাপারে যে, আমরা ভারতের সঙ্গে গুড ওয়ার্কিং রিলেশন, এই শব্দটা আমরা ব্যবহার করি। আমরা সেটা চাই এবং সেটা একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং পরস্পরমুখী স্বার্থের ভিত্তিতে। এটাই এবং এ ব্যাপারে আমাদের কোনো অস্পষ্টতা নেই।”
ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যকে ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের জন্য ‘ক্ষতিকর’ হিসেবেও বর্ণনা করেন তিনি। বলেন, “সম্পর্ক ভালো করতে গেলে তো বরং আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী যে ওখানে ভারতীয় আতিথেয়তায় থেকে যে বিভিন্ন কথাবার্তা বলছেন, এগুলো তো আসলে ক্ষতিকর, সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।
“ঠিকাছে, আমাদের অস্থিতিশীলতা, এগুলো আমাদেরকে সামাল দিতে হবে, কিন্তু উনার বক্তব্য যে সেটাতে আগুনে ঘি ঢালছে এটা তো স্বীকৃত ব্যাপার, সবাই জানে এটা।”
ভারতের প্রায় সব ভিসা বন্ধের বিষয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, “এটা সম্পূর্ণরূপে তাদের অধিকার। তারা কাউকে ভিসা না দিলে আমাদের কিছু বলার নাই। যখন ভিসা দেওয়া হচ্ছে না বা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাংঘাতিকভাবে, তখন আমরা তো বিকল্প খুঁজে নেবই।
“এগুলো হচ্ছে স্বাভাবিকতা। আমরা চাই ভালো সম্পর্ক। সেখানে কোনো সমস্যা থাকলে আমাদের বিকল্প দেখতেই হবে।”
সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গে জয়শঙ্করের বক্তব্যের বিরোধিতায় তিনি বলেন, “সংখ্যালঘু সম্পর্কে উনি আবার বলেছেন। সংখ্যালঘুর বিষয়টা হচ্ছে যে, এই অভিযোগগুলো প্রধানত ভারতীয় মিডিয়ার যে বিকৃত একটা তথ্যপ্রবাহ সৃষ্টি করেছে, তার ভিত্তিতে এইগুলো বিভিন্নজন বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে।”
তৌহিদ হোসেন বলেন, “তার থেকে বড় কথা হল যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু তো ভারতের বিষয় হতে পারে না। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বাংলাদেশের বিষয়; যেমন, ভারতের সংখ্যালঘু কেমন যত্ন পাবে, সেটা ভারতের বিষয়। আমি মনে করি যে, এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে আমাদের যেতে হবে।
“আমাদের সংখ্যালঘুদের বিষয়টা আমরা দেখছি। তারা বাংলাদেশের নাগরিক। আমার যতটুকু অধিকার আছে, তাদের প্রত্যেকের ঠিক ততটুকু অধিকার আছে, এদেশের উপরে। এবং সেটাই সরকার সবসময় বাস্তবায়ন করার চেষ্টার করবে।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সেখানেই আছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও অধিকাংশই এখনও আত্মগোপনে।
এর মধ্যেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের চালানো দমন পীড়নকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একাধিক মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।
এরপর প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর ভারত সরকারকে ‘কূটনৈতিকপত্র’ পাঠায় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে ভারত এখনও তার জবাব দেয়নি।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার পাশাপাশি দিল্লিতে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রচেষ্টার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে এনেছে ইউনূস সরকার।
অপরদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে ভারত সরকার। পাশাপাশি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও অপতথ্য’ এবং ‘অতিরঞ্জিত প্রচারণার’ অভিযোগ বাংলাদেশ সরকার করেছে।
বিভিন্ন বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত ইস্যু এবং শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক তলবের ঘটনাও ঘটেছে।
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক জানতে চান, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা বিভিন্ন ভারতবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন, কোনো কোনো সময় সেগুলো বেশ হিংসাত্মক। এগুলো দ্বিপক্ষীয় আলোচনা বা দ্বিপক্ষীয় দরকষাকষিতে প্রভাব ফেলছে কি না।”
উত্তরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাণধীর জয়সওয়াল বলেন, “হ্যাঁ, আমরা এ ধরনের বক্তব্যগুলো নজরে নিয়েছি, সেগুলো অবশ্যই ভালো কিছু নয়। কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে এর প্রভাব কী পড়বে, তা সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যক্তিরা তুলে ধরবেন।”
আরও পড়ুন: