“রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু নির্বাচন করবেন, দেশ চালাবেন তাদের মধ্যে ঐকমত্য জরুরি। আগে সেটা নিশ্চিত করতে হবে,” বলেন তিনি।
Published : 13 Feb 2025, 11:13 PM
সংস্কার পুরোপুরি বাস্তবায়নের পরে না কি প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচন হবে, এমন আলোচনার মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ বলেছেন, সংস্কার কতটুকু হবে তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানোকে এখন প্রধান করণীয় বলেও মনে করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু নির্বাচন করবেন, দেশ চালাবেন, তাদের মধ্যে ঐকমত্য জরুরি। আগে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”
এসময় সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ইতোমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন কর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এ কমিশনের কাজ শুরু হচ্ছে। এরইমধ্যে ছয় সংস্কার কমিশনের কাজও শেষ হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে।
এতে সহসভাপতি হিসেবে আছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাষ্ট্র সংস্কার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন অন্তর্বর্তী সরকার।
অক্টোবরে গঠিত সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কারে কমিশনগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ৮ ফেব্রুয়ারি।
তবে তার আগে থেকেই নির্বাচন নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে বিএনপি। দলটি বলছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে চলতি বছরের মাঝামাঝিতে নির্বাচন করা সম্ভব। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা পুরো সংস্কার বাস্তবায়নের পর নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কাজ শুরুর আগে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে এসে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করা। যেটায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সম্মত হবে যে ভবিষ্যতে তারা এ কাজগুলো করবে। আশা করি, সে জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে।”
তিনি বলেন, “সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ একটা আরেকটার সঙ্গে সংযুক্ত। স্কেল হয়ত ডাউন করা যেতে পারে, কিন্তু পুরো বাদ দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
“সেই বিবেচনায় প্রধান করণীয় হচ্ছে- ভবিষ্যতে যে নির্বাচন হবে. সেটা যখনই হোক, তার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং এ প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা যে তারা ক্ষমতায় গেলে, সব দলকে রাজি করাতে হবে বা কোন দল সংসদে না যেতে পারলেও তারও দায়িত্ব হচ্ছে এ সংস্কারের জন্য কাজ করা।”
কতটুকু সংস্কার হবে তা রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নির্ভর করবে মন্তব্য করে আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা বড় ধরনের কাঠামোগত সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছি। এগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমে দরকার জাতীয় ঐকমত্য। সেটা রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু নির্বাচন করবেন, দেশ চালাবেন তাদের মধ্যে ঐকমত্য জরুরি। আগে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
“তারা যদি ঐকমত্য পৌঁছান, তাহলে সেটি এখন করতে চান, নাকি নির্বাচনের পরে করতে চান, নাকি নতুন সংসদে করতে চান, নাকি গণভোটের মাধ্যমে করতে চান, তারাই নির্ধারণ করবেন।”
জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ
সুপারিশের বিষয়গুলো তুলে ধরে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, “আমরা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রোধের জন্যে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে জোরদার করার পাশাপাশি নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্যে সুপারিশ করেছি। এর অন্যতম হচ্ছে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি।
“প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাসের জন্যে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থার সুপারিশ করেছি। যার মধ্যে, তিনি (প্রধানমন্ত্রী হবেন যিনি) যেন একাধিক পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারেন, সেটা সুপারিশ করেছি। তার নিজের দলের সংসদ সদস্যদের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থার জন্যে ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছি।”
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং নাগরিকদের সুবিচার প্রাপ্তির জন্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের সুপারিশ রয়েছে বলেও তুলে ধরেন তিনি।
“… আমরা নাগরিকদের অধিকারগুলো সম্প্রসারণের ওপর জোর দিয়েছি এবং সেগুলো বলবৎকরণে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেছি।”
সাতটি বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কার প্রস্তাব
আলী রীয়াজ বলেছেন, কমিশন একটি কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবধিকার সুনিশ্চিত করতে এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাতটি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। সেগুলো হচ্ছে:
>>১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ প্রস্তাব।
>> ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা।
>> প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস।
>> অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব।
>> বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ।
>> শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।
>> মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিত করা।
৫০ হাজার মানুষের মতামত পেয়েছে কমিশন
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, বিদ্যমান সংবিধানের পর্যালোচনার পাশাপাশি নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে অংশীজনদের মতামত সংগ্রহ শুরু করে কমিশন। তারই অংশ হিসেবে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৫০ হাজার ৫৭৩ জনের মতামত পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে দেশের ৬৪টি জেলায় ৪৫ হাজার ৯২৫টি খানা (হাউজহোল্ড) থেকে মতামত নেওয়া হয়।
কমিশনের অনুরোধে ২৫টি রাজনৈতিক দল এবং তিনটি জোট তাদের লিখিত মতামত দিয়েছে, বলেন আলী রিয়াজ।
তিনি বলেছেন, “কমিশনের আমন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের ৪৩টি সিভিল সোসাইটি সংগঠনের ৯৯ জন প্রতিনিধি আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদের মতামত জানান। যার মধ্যে ২৫টি সংগঠন তাদের বক্তব্যের লিখিত ভাষ্য কমিশনের কাছে দেন। এর বাইরে ২৯টি সংগঠন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের মতামত আমাদের জানিয়েছেন।’
কমিশন সাতজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে তুলে ধরে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, “তাদের মধ্যে দুজন তাদের বক্তব্যের লিখিত ভাষ্যও আমাদের দিয়েছেন। সিভিল সোসাইটির ৩৭ জন ব্যক্তি আমাদের অনুরোধে উপস্থিত হয়ে তাদের মতামত দিয়েছেন, যার মধ্যে লিখিতভাবে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন ২০ জন।
“এর বাইরেও ৩৪ জন ব্যক্তি তাদের মতামত ই-মেইলে বা কমিশনের কার্যালয়ে এসে তাদের মতামত লিখিতভাবে জমা দিয়েছেন।
“রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তিদের অংশ নেওয়ার ফলে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক সুপারিশমালা তৈরিতে সমাজের এক ব্যাপক অংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে।”
কমিশন বিদ্যমান সংবিধানের পর্যালোচনা, অংশীজনদের মতামত এবং কমিশন সদস্যদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে সুপারিশমালা এবং সেগুলোর যৌক্তিকতা নির্ধারণ করেছেন বলে তুলে ধরেন আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, পাঁচ খণ্ডের এই প্রতিবেদনের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম খণ্ডে অংশীজনদের মতামত, জরিপের ফল এবং ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত মতামতের সারাংশ সংকলিত হয়েছে।
পুরনো খবর: