“মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করার ভূমিকার জন্য হলেও আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।”
Published : 26 Jan 2025, 08:19 PM
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, সাবেক সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহকে ঢাকা সেনানিবাসে শেষ বিদায় জানিয়েছেন রণাঙ্গনের সহকর্মী এবং বর্তমানের সেনা সদস্যরা।
রোববার আর্মি কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে অবসরপ্রাপ্ত এই মেজর জেনারেলকে শেষ বিদায় জানান তারা।
পরে ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে বনানীর সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় সফিউল্লাহকে।
আর্মি কেন্দ্রীয় মসজিদে তার জানাজায় অংশ নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌ পরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনও জানাজায় অংশ নেন।
রোববার সকালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান মুক্তিযুদ্ধে এস ফোর্সের প্রধান সফিউল্লাহ।
জোহরের নামাজের পর তার স্থায়ী নিবাসের এলাকা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কাজী আবদুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয়ে তার জানাজা হয়।
নবতিপর সফিউল্লাহ দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, থাইরয়েডে জটিলতা, ফ্যাটি লিভার, ডিমেনশিয়াসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় তিনি আক্রান্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন তার চলাফেরা ছিল স্ট্রেচারে।
১৯৭১ সালে সফিউল্লাহ ছিলেন জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় প্রধান। তার নেতৃত্বেই ওই রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সফিউল্লাহ ছিলেন ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। পরে তিনটি নিয়মিত আর্মি ব্রিগেড (ফোর্স নামে পরিচিত) গঠিত হলে ‘এস’ ফোর্সের নেতৃত্বে আসেন সফিউল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ‘বীর উত্তম’ খেতাব পান।
১৯৩৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জন্ম নেওয়া কে এম সফিউল্লাহ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। পরে মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইডেন, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১ সালে দেশে ফিরে এলে তাকে এক বছর ওএসডি করে রাখা হয়। পরের বছর তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যান।
১৯৯৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনকে বেগবান করতে মুক্তিযুদ্ধের জীবিত সেক্টর কমান্ডাদের নিয়ে ২০০৭ সালে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠিত হলে সফিউল্লাহ ছিলেন সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। পরে তিনি এ সংগঠনের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালে একদল সেনাসদস্য যখন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে, সফিউল্লাহ তখন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের প্রতি তিনি আনুগত্যও প্রকাশ করেছিলেন। তবে কয়েক দিনের মধ্যে তাকে সেনাপ্রধানের পদ হারাতে হয়।
সফিউল্লাহ অবশ্য পরে বলছিলেন, তিনিসহ ওই সময়কার বিমানবাহিনী প্রধান ও নৌবাহিনী প্রধানকে ‘বাধ্য হয়ে’ মোশতাক সরকারের প্রতি সমর্থন দিতে হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য তখনকার সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে দায়ী করেন আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে। এ বিষয়ে সফিউল্লাহ পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এ রকম অবস্থায় সেনাপ্রধান কী করতে পারেন?”
জানাজায় অংশ নিতে এসে কেএম সফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন ৩ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করার ভূমিকার জন্য হলেও আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।”
বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু যে ডাকটা দিয়েছিলেন ৭ মার্চে, উনি বলেছিলেন যার যা আছে, তৈরি হয়ে যাও। তো, বাংলাদেশের সকল জনগণ, সকল তরুণ, এবং যার কাছে যা ছিল তা নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল।
“কিন্তু উনার সেই ডাকটা সেনাবাহিনীতে প্রথম যারা শুনেছিল ছিল সেটা হল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, জুনিয়র টাইগার্স; সেটি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এই আজকে যাকে আমরা বিদায় জানালাম।”
একাত্তরের সেই সময়কার কথা স্মরণ করে হেলাল মোর্শেদ বলেন, “সৈনিক দল হিসাবে পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে উনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, সৈনিকদেরকে একত্র করেছিলেন, সেই একত্রিত সৈনিকরা সৈন্যদল হিসাবে সমস্ত অস্ত্র, গোলাবারুদ, সবচেয়ে শক্তিশালী একটি ইউনিট হিসাবে বিদ্রোহ করে ময়মনসিংহে গিয়ে সমাবেশ করে, তারপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে।
“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর সৈনিকরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে, জনগণের ডাকে যে সাড়া দিয়েছিল, সেটি প্রথম দিয়েছিল এই দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ঢাকার অদূরে, ২০ মাইল দূরে থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষুকে ভয় না করে তারা বিদ্রোহ করেছিল। বাংলাদেশের জন্ম যদি হয়ে থাকে, সেখানে যদি যুদ্ধ হয়ে থাকে, এরাই প্রথম যুদ্ধ শুরু করেছিল এবং সেই নেতৃত্বটি উনার ছিল “
মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ অবদানের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গঠনে সফিউল্লাহর ভূমিকা আজীবন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হবে বলে মনে করেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সহসভাপতি, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “উনি সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, ফোর্স কমান্ডার ছিলেন। অত্যন্ত বীরত্বের সাথে তিনি পাকিস্তান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। সুতরাং সেটাই উনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ট ইতিহাস হল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এবং সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি।
“শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে তিনি শ্রেষ্ঠ অবদান রেখেছেন সেই সময়। সুতরাং এর সাথে কোনো তুলনা হবে না, উপমা হবে না, এটা বিরল ভূমিকা। আজকে তিনি পরিণত বয়সে চলে যাচ্ছেন। ওটা জাতি সারাজীবন মনে রাখবে।”
১৯৭৫ সালে কমিশনপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “স্বাধীন হওয়ার পরে (১৯৭২ সালের এপ্রিলে) তিনি (সফিউল্লাহ) সেনাপ্রধান হন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে গড়ে উঠেছে, এই সেনাবাহিনীর যে জন্ম, তার সাথে তিনি অসাধারণ অবদান রেখেছেন। সুতরাং এটা জাতি বলেন, সেনাবাহিনী বলেন- এটা সবাই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ রাখবে।”