তারিক সিদ্দিকের পরিবার কীভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করেছিল, ফাঁস হওয়া নথিতে তার বিস্তারিত তুলে ধরেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদপত্রটি।
Published : 11 Jan 2025, 12:06 AM
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের স্ত্রী শাহীন সিদ্দিক ও মেয়ে বুশরা সিদ্দিক মাল্টার নাগরিকত্বের আবেদন জানালেও ‘অর্থপাচার, দুর্নীতি, প্রতারণা ও ঘুষের’ অভিযোগ থাকায় তা পাননি বলে খবর দিয়েছে দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।
ফাঁস হওয়া নথির বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদপত্রটি বলছে, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে দুই দফায় নাগরিকত্বের আবেদন জানিয়েছিলেন শাহীন সিদ্দিক। দ্বিতীয় দফায় তার সঙ্গে মেয়ে বুশরা সিদ্দিকও আবেদন করেন।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, সরকারের জমি দখল করা একটি কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগ ছিল শাহীন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে। প্রথমবার নাগরিকত্ব না দেওয়ার পেছনে ওই অভিযোগের কথা বলেছিল ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস’।
ওই সময় মাল্টায় বিনিয়োগের বিনিময়ে বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার যে কর্মসূচি ছিল, তা দেখভালের দায়িত্বে ছিল এই ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস’।
শাহীন সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের চাচি। অন্যদিকে ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার পতনের দিন পর্যন্ত তার সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন শহীনের স্বামী তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
তারিক সিদ্দিকের পরিবার কীভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার আয়োজন করেছিল, ফাঁস হওয়া নথিতে তার বিস্তারিত তথ্য থাকার কথা জানিয়েছে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।
নাগরিকত্ব না দেওয়ার পেছনে ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস’ ২০১২ সালের একটি অভিযোগ সামনে আনে। ওই অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ‘প্রচ্ছায়া’ নামের একটি কোম্পানি।
প্রচ্ছায়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, কোম্পানিটি ঢাকায় সরকারের অনেক দামি একটি জমি হাতিয়ে নিয়েছে।
নাগরিকত্বের আবেদনে নিজেকে প্রচ্ছায়ার চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন শাহীন সিদ্দিক। আর বুশরার পদ ছিল কোম্পানির পরিচালক।
ফাঁস হওয়া নথি বলছে, ২০১৫ সালে মা-মেয়ে যৌথভাবে যে আবেদন করেছিলেন, তাতে নাগরিকত্ব পেতে শাহীন সিদ্দিকের খরচ পড়ত ছয় লাখ ৫০ হাজার ইউরো। আর বুশরার লাগত ২৫ হাজার ইউরো। এর বাইরে ফি হিসেবে ৭০ হাজার ইউরো নিত ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস’।
ওই আবেদনের অংশ হিসেবে ব্যাংকে ডলার থাকার একটি স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন শাহীন সিদ্দিক। সেখানে তিনি কুয়ালা লামপুরের একটি ব্যাংক হিসাবে ২৭ লাখ ৬০ হাজার ৪০৯ ইউরো থাকার তথ্য দিয়েছিলেন।
তিনি যখন এই তথ্য দেন, তার আগের দুই মাসে ১১টি লেনদেনের মাধ্যমে তার হিসাবে ওই অর্থ জমা হয়। কিন্তু ওই অর্থের উৎস কী ছিল, তা ফাঁস হওয়া নথিতে বলা হয়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, “বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী, এক বছরে কারো পক্ষে ১২ হাজারের বেশি ডলার দেশের বাইরে নেওয়ার সুযোগ নেই।”
বুশরা ওই সময় লন্ডনে লেখাপড়া করতেন। নাগরিকত্বের আবেদনে তার ঠিকানা লেখা ছিল সেন্ট্রাল লন্ডনের ‘গথিক’ ভবন। লন্ডনের কিংস ক্রসে টিউলিপ সিদ্দিকের যে বাসা রয়েছে, সেখান থেকে কয়েক মিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বে এর অবস্থান।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, প্রথমবার নাগরিকত্বের আবেদন নাকচ হওয়ার কারণ জানিয়ে একটি মেইল করে হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস। তাতে প্রচ্ছায়ার মাধ্যমে জমি দখল, অর্থপাচার, দুর্নীতি, প্রতারণা ও ঘুষের অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এসব অভিযোগ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে আসার কথাও তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটি।
দ্বিতীয়বার যৌথ আবেদনে প্রচ্ছায়ার কথা রাখেননি শাহীন সিদ্দিক। দ্বিতীয়বার তিনি নিজের কোম্পানির নাম দেন ‘দ্য আর্ট প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড’। কোম্পানির ঠিকানা দেওয়া ছিল চট্টগ্রামের।
তখন হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস একটি মেইলে তাদের জানিয়ে দেয়, কোম্পানির বিষয়ে মাল্টা কর্তৃপক্ষের আরও তথ্য প্রয়োজন। জবাবে কোম্পানির পক্ষ থেকে ফিরতি ইমেইলে বলা হয়, ‘দ্য আর্ট প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড’ ১৯২৬ সালে শাহীন সিদ্দিকের দাদার হাত ধরে যাত্রা শুরু করে।
শুরুতে প্রিন্টিং ছিল এর মূল ব্যবস্থা। শাহীন সিদ্দিক ২০১৩ সাল থেকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন বলেও ফিরতি মেইলে তথ্য দেওয়া হয়।
ফাঁস হওয়া নথিপত্রে দেখা গেছে, যাদের আবেদন নাকচ কিংবা বাতিল হয়ে গিয়েছিল, তাদের তালিকায় শাহীন সিদ্দিকের নামও রয়েছে।
মাল্টার সরকারি গেজেটও নিশ্চিত করেছে, শাহীন সিদ্দিক কিংবা তার মেয়ে বুশরা, কেউ তাদের পাসপোর্ট পাননি।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, লেখাপড়া শেষ করে যুক্তরাজ্যেই থেকে যান বুশরা। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে স্নাতক সম্পন্নের পরেই জেপি মরগ্যানে যোগ দেন তিনি। সেখানে কিছুদিন চাকরি করার পর ২০১৮ সালে ‘লাইফস্টাইল, ফ্যাশন ও ট্রাভেল’ ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন।
গুমের মামলায় গত সোমবার শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই ১১ জনের মধ্যে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নামও রয়েছে।
গণ অভ্যুত্থানের মুখে গত অগাস্টে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর তার পরিবারের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে দুদক।
রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের ‘আর্থিক অনিয়মের’ যে অভিযোগ উঠেছে সেখানে সেখানেও শাহীন সিদ্দিকের সেই ‘প্রচ্ছায়া’ কোম্পানির নাম এসেছে।
দুদকের বরাত দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক নথিতে বলা হয়েছে, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ (জয়) এবং ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক (তারিক আহমেদ সিদ্দিকের ভাতিজি) ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেছেন, যা পাচার করা হয়েছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।”
কীভাবে ওই অর্থ ‘পাচার’ করা হয়েছে, সে বিষয়েও একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সারসংক্ষেপে।
সেখানে বলা হয়, তারিক আহমেদ সিদ্দিকর স্ত্রী ও মেয়ে প্রচ্ছায়া লিমিটেড (নিবন্ধন সনদ নম্বর সি-৭৫৬৫৯/০৯, তারিখ ২৫ মার্চ ২০০৯) নামের একটি ‘ভুয়া কোম্পানির’ অংশীদার। ওই কোম্পানি ‘ডেসটিনি গ্রুপ নামের একটি চিট ফান্ড কোম্পানির’ সঙ্গে যুক্ত ছিল।
“প্রচ্ছায়া লিমিটেড যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করেছে। ওই অর্থ দিয়ে যুক্তরাজ্যে জুমানা ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড প্রোপার্টিস লিমিটেড (নিবন্ধন সনদ নম্বর ৭৪১৭৪১৭, তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১০) নামের একটি কোম্পানিও খোলা হয়েছে।”
ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সেবাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ ও তার বোন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তির কাছ থেকে লন্ডনে দুটি বাড়ি উপহার নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পর সেখানেও তোলপাড় চলছে।
লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেইট আসনের এমপি টিউলিপ তার নির্বাচনী এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ব্যবহার করতেন, যেটা তার ছোট বোন আজমিনাকে ‘উপহার’ দিয়েছিলেন মঈন গণি নামের এক আইনজীবী, যিনি শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ছবিও আছে।
আর টিউলিপ নিজে লন্ডনের ‘কিংস ক্রস’ এলাকায় একটি ফ্ল্যাট উপহার পেয়েছেন আবদুল মোতালিফ নামের এক আবাসন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে, যার বর্তমান মূল্য ৭ লাখ পাউন্ড। মোতালিফের সঙ্গেও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের যোগসূত্র থাকার খবর এসেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে।
টিউলিপের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আওয়ামী লীগের প্রতি তার সমর্থনের সঙ্গে এসব সম্পত্তির যোগসূত্র থাকার ধারণা ‘একেবারেই ভুল'।
তবে তার সরে যাওয়ার দাবি জোরালো হয়ে ওঠায় টিউলিপ ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ইনডিপেনডেন্ট এথিকস অ্যাডভাইজর (স্ট্যান্ডার্ডস ওয়াচডগ) স্যার লাউরি ম্যাগনাসকে অনুরোধ জানিয়েছেন।