মমতা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গকে ‘পাশ কাটিয়ে’ ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন বা তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া ‘অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত’।
Published : 24 Jun 2024, 10:07 PM
এক যুগেও তিস্তা চুক্তির জট ছাড়াতে না পারা ভারত সরকার যখন চীনের পাল্টা চালে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে, তখন আবারও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সতর্ক করে তিনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গকে ‘পাশ কাটিয়ে’ ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন ও তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া ‘অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত’।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে। তাদের দাবি, ফারাক্কা চুক্তি নবায়নের বিষয়ে অন্তত তিন দফা পশ্চিমবঙ্গ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে দুই দেশের আলোচনার টেবিলে অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মধ্যে তিস্তার প্রসঙ্গও ছিল। সেখানেই দিল্লির পক্ষ থেকে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখানো হয়।
শনিবার শেখ হাসিনার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, তার সরকার ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কারিগরি পর্যায়ের আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতের একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।
২০১১ সালে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আটকে দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবারও দিল্লির আগ্রহ ভালোভাবে নেননি। সোমবার মোদীকে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে ‘কোনোভাবেই’ তিস্তার পানি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ পানি ভাগাভাগি করতে হলে পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ পানীয় জল ও সেচের পানি থেকে ‘বঞ্চিত’ হবে।
গঙ্গার বণ্টন চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রেও মমতার প্রবল আপত্তি রয়েছে। তিনি বলেছেন, ফারাক্কা বাঁধের কারণে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নদী শুকিয়ে যাওয়ায় কৃষি ক্ষেত্রে সমস্যা বেড়েছে, মানুষ পানীয় জলের সংকটেও ভুগছে।
মোদীকে লেখা চিঠি মমতা বলেছেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন প্রশ্নে আলোচনা হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গে সলাপরামর্শ না করে, মতামত না নিয়ে এককভাবে কেন্দ্রের এমন আলোচনা-পর্যালোচনা অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত।”
জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরে তিস্তা প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার ‘সম্ভাবনার’ মধ্যে গঙ্গা ও তিস্তা নিয়ে দিল্লির নতুন প্রস্তাবের খবর ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছে।
হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, তিস্তা নদীর ড্রেজিং ও উন্নয়নের বিষয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা পরিকল্পনায় ভারতের আগ্রহী হওয়ার ঘোষণা প্রকল্পটির বিষয়ে চীনের চাপের প্রেক্ষাপটে বেশ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
“চীনা কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে ঢাকাকে নয়া দিল্লির উদ্বেগ জানানোর মধ্যে বেইজিং প্রায় ১০০ কোটি ডলারের আনুষ্ঠানিক প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছে।”
ফারাক্কা চুক্তি ও তিস্তার পানি বণ্টন বা তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ- দুটো বিষয়ই বাংলাদেশের অগ্রাধিকারে রয়েছে। ২০২৬ সালে ফারাক্কা চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে, ফলে সে চুক্তির নবায়ন চায় ঢাকা। নরেন্দ্র মোদীও এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর।
বাংলাদেশের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বলে মন্তব্য করে মোদীকে লেখা চিঠিতে মমতা বলেছেন, “আমি বাংলাদেশের জনগণকে ভালোবাসি ও সম্মান করি এবং সবসময় তাদের মঙ্গল চাই।”
অতীতে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্য সরকার ‘সহযোগিতা করেছে’ দাবি করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন এবং এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য রেললাইন ও বাস সেবা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে করা কয়েকটি ‘দৃষ্টান্তমূলক’ যৌথকাজ রয়েছে।
“তবে পানি খুবই মূল্যবান এবং জনগণের জন্য লাইফলাইন। জনগণের ওপর বহুমাত্রিক ও মারাত্মক প্রভাব ফেলা এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে আমরা কোনো ছাড় দিতে পারব না। এ ধরনের কোনো চুক্তি হলে তার ভয়ংকর প্রভাবের শিকার হবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।”
ফারাক্কা চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে ‘তথ্য পাওয়ার’ কথা জানিয়ে মোদীকে তিনি লিখেছেন, “১৯৯৬ সালের এ চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি ভাগাভাগির শর্তের বর্ণনা রয়েছে। আপনি অবহিত রয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবিকা নির্বাহে এ পানির বিশাল ভূমিকা রয়েছে এবং ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে পাঠানো পানিতে কলকাতা বন্দরের নাব্য বাঁচিয়ে রাখা হয়।”
বহু বছর ধরে ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশে নদীর গতিপ্রকৃতি বদলে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে মমতা লিখেছেন, এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে এবং রাজ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
“গত ২০০ বছর ধরে গঙ্গা (বাংলাদেশের পদ্মা) পূর্বমুখী হওয়ায় (ভারতের বিবেচনায়) কয়েকটি নদীর সঙ্গে এর আর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। জলাঙ্গি ও মাথাভাঙ্গা তার মধ্যে দুটি নদী, যারা পদ্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে গেছে।”
মমতার ভাষ্য, ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প শুরু করায় ভাগীরতী নদী পদ্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ প্রকল্পের আওতায় কলকাতা বন্দরের জন্য ৪০ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার জন্য একটি খাল খনন করার কথা। ব্যারেজ নির্মাণের পর গত কয়েক বছর ধরে হুগলি অংশে পানির প্রবাহ কমে গেছে। তা ছাড়া উজানে ও ভাটিতে নদী ভাঙনে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে বহু মানুষ; জীবিকাও হারিয়েছে অসংখ্য।
ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতি ও নদীভাঙন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্র সরকার, যা আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
এসব বিষয় তুলে ধরে এর আগেও তিনবার প্রধানমন্ত্রী মোদীকে চিঠি দেওয়ার কথা সোমবারের চিঠিতেও লিখেছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী।
তিনি লিখেছেন, এরপরও বৈঠকে (হাসিনা-মোদী) তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। সিকিমে তিস্তার ওপর একের পর এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করায় নদীর স্বাস্থ্য এখন ভালো নেই। এর ফলে উজানে নদী অববাহিকায় বন কমছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনেও এটি ভূমিকা রাখছে।
“তারপরও বাংলাদেশ অংশে তিস্তার সুরক্ষা ও পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আগ্রহ দেখিয়েছে কেন্দ্র সরকার। এ কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি, যেখানে তিস্তার উৎসভূমিতে একে রক্ষা করতে এবং ভারতীয় অংশে এর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এখনও কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পর্যন্ত।
“এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে যদি তিস্তার পানি ভাগাভাগি করা হয়, তাহলে চাষাবাদের পানির অভাবে উত্তরবঙ্গে (পশ্চিমবঙ্গের) বিপর্যয়কর প্রভাব পড়বে। তা ছাড়া পান করার জন্যও উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের তিস্তার পানি খুবই প্রয়োজন। এসব বিষয় মাথায় রেখে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।”
শেষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে মোদীকে সতর্ক করে মমতা বলেছেন, তিস্তার পানি ও ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া যেন কোনো কিছু না করা হয়।
তবে মমতার ওই দাবি ‘ভুয়া’ দাবি করে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গঙ্গা চুক্তির অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার জন্য ভারত সরকার যে কমিটি করেছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই। ওই বছর ২৫ অগাস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার সেচ ও নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে (নকশা ও গবেষণা) তাদের প্রতিনিধি মনোনীত করে। আর পশ্চিমবঙ্গের সেচ ও নৌ পরিবহন বিভাগের যুগ্ম সচিব (কর্ম) এ বছরের ৫ এপ্রিল ফারাক্কা বাঁধের ভাটির জলবণ্টনে আগামী ৩০ বছরের মোট হিস্যার দাবিও কমিটিকে জানিয়েছিলেন।
এদিকে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনায় চীনের অর্থায়নের প্রস্তাব বেশ কিছুদিন ধরেই ঝুলে রয়েছে। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে তিস্তার বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে বলে কূটনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে।
এর মধ্যে ভারত এ প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখানোয় চীনের ‘চাপকে’ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য ‘সহজ’ হবে বলে মন্তব্য করা হয়েছে হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে।
এখন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরোধিতায় দিল্লি শেষপর্যন্ত কতটা এগোতে পারবে, তা নিয়েও আলোচনা চলছে ভারতের সংবাদমাধ্যমে।