আপিলকারী ও রিটকারী ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টে নয়জন আইনজীবী শুনানিতে অংশ নিয়ে মতামত দেন।
Published : 21 Jul 2024, 05:44 PM
সরকারি চাকরির কোটা ফিরিয়ে আনতে হাই কোর্টের যে রায়ের পর আন্দোলন ও সহিংসতা ঘটে গেছে, তার বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানিতে ওই রায়ের নানা দিক আলোচনা করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।
রোববার প্রায় তিন ঘণ্টার শুনানি শেষে হাই কোর্টের রায় বাতিল করে কোটার নতুন বিন্যাস ঠিক করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনার সন্তানের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ এবং কোটা সংরক্ষিত থাকবে। বাকি ৯৩ শতাংশ পদে নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। তবে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী এই হার পরিবর্তন করতে পারবে।
আপিল শুনানিতে পক্ষে বিপক্ষের আইনজীবীরা ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী বক্তব্য দেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
এ এফ হাসান আরিফ, জেড আই খান পান্না, তানিয়া আমীর, সারা হোসেন, জয়নাল আবেদীন, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ইউনুস আলী আকন্দ, এহসানুল করিম ও তানজীবুল আলম স্বেচ্ছায় (ইন্টারভেনার) শুনানিতে অংশ নেন।
আপিলকারী রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন; দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক। রিটকারী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলাম ও অন্যদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী।
সকাল ১০টা ২০ মিনিটে আসন গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং অপর ছয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, আশফাকুল ইসলাম, আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, শাহীনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।
দৈনিক কার্যতালিকার ৩ নম্বরে থাকা আলোচ্য আপিল আবেদনের শুনানি শুরু করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন হাই কোর্টের রায়কে ‘সাংঘর্ষিক’ বলেন।
তিনি বলেন, ইতোপূর্বে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ে কোটা পদ্ধতি বহাল রেখে তা মানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল; এবারের হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগের ওই রায় না মানা হবে অবমাননার শামিল।
অন্যদিকে আবার বলা হয়েছে, সরকার ইচ্ছা করলে কোটা বাড়াতে বা কমাতে পারবে। তাই ‘সাংঘর্ষিক এবং আইনের দৃষ্টিতে ‘অগ্রহণযোগ্য’ এ রায় তিনি বাতিল চান।
এ সময় সংবিধানে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ তোলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের কারণ উল্লেখ করতে হয়। সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ‘বিদ্বেষপ্রসূত’ বা ‘স্বেচ্ছাচারী’ হলে তাতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ সংবিধান দিয়েছে।
কিন্তু হাই কোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘এমন কিছু নেই’ বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
এরপর দুই আপিলকারী শিক্ষার্থীর পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক। তিনিও হাই কোর্টের রায় বাতিল চান।
আপিলকারী পক্ষের শুনানি শেষে আসেন রিটকারী মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের আইনজীবী মনুরুল হক চৌধুরী।
তিনি বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের ৯২ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ; ৮ শতাংশ শহরের। তারা কিছু পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করেননি। তাদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা দিয়েছিলেন। অনগ্রসর বিবেচনায় তাদের কোটা দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে ২১ বছর এ কোটা দেওয়া হয়নি।
এ সময় প্রধান বিচারপতি ‘অনগ্রসর’ কারা তা নির্ধারিত হয়নি বললে মনসুরুল হক বলেন, “এটি ধরে নিতে হবে। ২০১৮ সালে পুরো কোটা পদ্ধতি বাতিল হয়নি, আংশিক বাতিল হয়েছিল; এটি বৈষম্যমূলক। পরিপত্রে কোটা বাতিলের কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি।”
এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আজকে একটা বিশেষ অবস্থায় আমরা কোর্টে বসেছি। আপনি বলেন, এ রকম একটি নীতিনির্ধারণী বিষয়ে হাই কোর্ট রায় দিতে পারে কি না।”
মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, যারা ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন করেছে তারা সংস্কার চেয়েছে।
তিনিও সংস্কার চান কিনা– প্রধান বিচারপতির এমন প্রশ্নে মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, “যৌক্তিক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সংরক্ষণ করে সংস্কার হোক, তাতে আমার আপত্তি নেই।”
সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবীর বক্তব্য
আপিলকারী ও রিটকারী আইনজীবীদের শুনানি শেষে একে একে আসেন সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী।
শুরুতে অ্যাডভোকেট এহসানুল করিম হাই কোর্টের রায়টি ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলেন।
এরপর তানিয়া আমীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের সম্পর্কে কথা বলেন। যাদের ‘জন্মই হয়নি’ তাদের অনগ্রসর বলে মানতে তিনি নারাজ।
তানিয়া আমীর বলেন, “মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর গোষ্ঠী নন; তারা জাতির অগ্রগামী সৈনিক। তারা আমাদের গর্ব।”
জেড আই খান পান্না বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা কিছু পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করেননি। তারা চান রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সঠিকভাবে হওয়া দরকার।
সারা হোসেন বলেন, সংস্কার করার সময় নির্ধারিত প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে; এবং সেটি যুক্তসঙ্গত হতে হবে।
নারী অধিকার ও মানবাধিকার সনদসহ তিনটি আন্তর্জাতিক সনদে যে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সারা হোসেন বলেন, নারীদের জন্য কোটা রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের রয়েছে।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ বলেন, সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিষয়ে হাই কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারে না; কিছু মাপকাঠি বিবেচনায় করতে পারে। তবে কোন মাপকাঠিতে এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে তা হাই কোর্টের রায়ে আসেনি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন হাই কোর্টের রায় কিংবা সংবিধানের কোনো আলোচনায় না গিয়ে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ তোলেন। এ সময় আদালত তার কথা না শুনে তাকে বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত করেন।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নাল আবেদীনও কোটা সংস্কারের পক্ষে মতামত দেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতই বহাল থাকে।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন।
গত ৫ জুন সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাই কোর্ট বেঞ্চ কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে।
হাই কোর্টের রায়ের পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে আন্দোলনে নামে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা, পরে তা সহিংস রূপ পায়।