“আমি ৬ বছর ধরে সেই ছেলের কাছ থেকে আলাদা ছিলাম; এই সুযোগে সরকার গোয়েন্দাদের ব্যবহার করে আমার ষোল বছরের ছেলেকে দিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করে,” বলেন তিনি।
Published : 16 Jan 2025, 12:07 AM
দেশে গত বছরের জুনে রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, সেটি ধামাচাপ দিতেই আওয়ামী লীগ সরকার ১২ লাখ টাকার ছাগলের খবর ভাইরাল করে বলে দাবি করেছেন রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান।
বুধবার অস্ত্র আইনের মামলার শুনানিতে আলোচিত এই কর্মকর্তা বলেন, “ভাইরালের ব্যাপারটা মূলত তখনকার রাসেলস ভাইপার সাপ আতঙ্ক থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে ছাগলকাণ্ডে আমার পরিবারকে জড়ানো হয়।
“আমি ৬ বছর ধরে সেই ছেলের কাছ থেকে আলাদা ছিলাম। এই সুযোগে সরকার গোয়েন্দাদের ব্যবহার করে আমার ষোল বছরের ছেলেকে দিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করে।”
আদালতে নিজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে উল্টো বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হওয়ার বর্ণনা দেন মতিউর রহমান।
তিনি বলেন, “আমি আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধা নেইনি, বরং আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে ওএসডি করা হয়। আমাকে শিবির ক্যাডার হিসেবে তকমা দিয়ে প্রায় দেড় বছর ওএসডি করে রাখে সরকার। পরবর্তীতে আমি পুনরায় চাকরিতে যোগদান করি।
“আমার দেওয়া সিদ্ধান্তে পোশাকখাতে সরকারের ২৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। আমার এসব উদ্যোগের জন্য তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়তে হয়। আমাকে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হয়। একপর্যায়ে আমাকে জোর করে রাজস্ব অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে বসায়। এখানে কোনো আইনজীবী বলতে পারবে না ট্রাইব্যুনালে থাকাবস্থায় আমি এক টাকার দুর্নীতি করেছি। ট্রাইব্যুনালের ১২ হাজার মামলা জট নিষ্পত্তি করেছি।”
একপর্যায়ে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় তিনি বলেন, “সব কথা তো বলতে পারছি না, তবে আমার গল্প শুনলে প্রত্যেকটা হৃদয় কাঁদবে। কোনো কিছু না জেনে দয়া করে একটা ফ্যামিলিকে ধ্বংস করবেন না। ইনশাআল্লাহ আমাদের ফ্যামিলির বিরুদ্ধে মামলা টিকবে না।”
মঙ্গলবার রাতে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী লায়লা কানিজকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তার বাসা থেকে একটি অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। পরে ভাটারা থানায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়।
বুধবার ভাটার থানার মামলাটিতে মতিউর রহমানকে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ। আর তার স্ত্রীকে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
মতিউরকে দশ দিন রিমান্ডে নিতে আদালতে ভাটারা থানার এসআই রুবেল মিয়া তার আবেদনে বলেন, তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থাকায় দুদক মামলা দায়ের করেছে। তিনি আওয়ামী ‘ফ্যাসিস্ট রেজিমে’ সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম।
“তার হাত ধরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। দুদকের মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালালে তার বাসা থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এই অস্ত্র বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে ব্যবহার হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।”
আর রিমান্ড আবেদন বাতিল চেয়ে আইনজীবী আবু সুফিয়ান শুনানিতে বলেন, “যে মামলায় তাকে রিমান্ডে চাওয়া হয়েছে, সেখানে রিমান্ডে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি টেস্ট কেস হিসেবে এক রাউন্ড গুলি ছুড়েছিলেন, তবে কোনো জিডি করেননি। আর যে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, সেটা লাইসেন্স করাই ছিল তবে নবায়ন করা ছিল না। রিমান্ডে নিলে তিনি (মতিউর) এসব কথাই বলবেন।”
অবৈধ সম্পদের অভিযোগের ব্যাপারে আইনজীবী আবু সুফিয়ান বলেন, “মতিউর রহমান তার নিজ যোগ্যতাবলে এনবিআরের কর্মকর্তা নিয়োগ পান। তিনি তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সরকারের দেওয়া উপহারে অনেক টাকা অর্জন করেছেন। তার অবৈধ কোনো সম্পদ নেই।”
শুনানি চলাকালে মাগরিবের আজান হলে আবু সুফিয়ান বলেন, মতিউর রহমান রোজা ছিলেন। সেসময় আদালতের উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাকে পানি পান করান।
পরে মতিউর তার অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপারে আদালতকে বলেন, “টেস্ট করতে আমি একটি মিস ফায়ার করেছিলাম। তবে এ বিষয়ে জিডি না করাটা আমার মিস্টেক হয়েছে।”
উভয়পক্ষের কথা শুনে মতিউরের তিন দিন রিমান্ডের আদেশ দেন ঢাকা মহানগর হাকিম নাজমিন আক্তার।
বসুন্ধরার বাসা থেকে মতিউর ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের সময় জিজ্ঞাসাবাদে তাদের শয়নকক্ষের আলমারি থেকে একটি বিদেশি পিস্তলও পায় পুলিশ।
এজাহারে বলা হয়, অস্ত্রটির লাইসেন্সের মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হয়ে হওয়ার পরেও তা কেন নিজের হেফাজতে রেখেছেন সে বিষয়ে মতিউর সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি ২৫ রাউন্ড গুলিসহ অস্ত্রটি কেনার কথা বললেও জব্দ করার সময় ২৪ রাউন্ড গুলি পাওয়া গেছে। বাকি গুলিটি তিনি কি করেছেন তারও কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। এ কারণে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলাটি করা হয়েছে।
ঘটনাক্রম
গত বছর কোরবানির জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ফেইসবুক পোস্ট ঘিরে মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় সমালোচনা শুরু হয়।
তার আগে ছাগল কিনতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ইফাত। ধানমন্ডির বাসায় ঈদের দিন ছাগলটি কোরবানি দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তখন ছাগলসহ ইফাতের ছবি জুড়ে দিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন- ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার অর্থের উৎস কী?
এ প্রশ্ন ঘিরে সামনে আসতে থাকে ইফাতের পরিচয়। ইফাত নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে ও সংবাদমাধ্যমে বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমান।
ইফাতের বাবার পরিচয় ধরে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল ব্যয়ে কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য হল কী করে?
অবশ্য ছাগলটি ইফাত শেষপর্যন্ত কেনেননি বলে দাবি সাদিক এগ্রোর কর্ণধার মোহাম্মদ ইমরান হোসাইনের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ইফাত শুধু ১ লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটির বুকিং করেছিলেন। তবে অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ছাগলটির তিনি আর নিয়ে যাননি।
বিষয়টি নিয়ে ইফাতের বক্তব্যও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। তার দাবি, ইমরান হোসাইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তার ‘অনুরোধে’ ছাগলটি নিয়ে প্রচারের জন্য এতটা দামের কথা বলে পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি।
মতিউর রহমান এ আলোচনায় ‘ঘি ঢেলেছেন’ ছেলের পরিচয় ‘অস্বীকার’ করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান।
এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেইসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়।
এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা।
আরও পড়ুন-
ছাগলকাণ্ড: মতিউরের তিন দিনের রিমান্ড, স্ত্রী কারাগারে