মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে বাড়তি অর্থ আদায় করে ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পেয়েছে দুদক; অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছেন তিন কর্মকর্তা।
Published : 18 Aug 2024, 08:36 PM
আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী-কন্যা এবং তিন সাবেক সংসদ সদস্যের এক চক্র মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছে দুদক।
ওই অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক নুরুল হুদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে।
যে অভিযোগ দুদক হাতে পেয়েছে, তাতে মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামাল, তাদের মেয়ে নাফিসা কামাল, ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজামউদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদ যুক্ত আছেন ওই সিন্ডিকেটে।
দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “মালয়েশিয়া শ্রমবাজার চক্রে ঢুকে তাদের রমরমা ব্যবসা সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।”
ঠিক কী অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আছে জানতে চাইলে দুদক সচিব বলেন, “মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে তারা বিদেশে কর্মী পাঠিয়েছে। আবার তাদের নিজস্ব এসব রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর হারও অনেক বেশি।”
দুদকের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে অভিযোগ সংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে দুদক। তাতে বলা হয়েছে, ফেনী থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড নামে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন। সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে পাঠায় ওই এজেন্সি। কিন্তু 'মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটে' যোগ দেওয়ার পর গত দেড় বছরে প্রায় ৮ হাজার কর্মী সে দেশে গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির মাধ্যমে। মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর্মী পাঠানো এজেন্সির তালিকায় ৪ নম্বরে রয়েছে স্নিগ্ধা ওভারসিজ।
ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ২০১৫ সালে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সি খোলেন। মালয়েশিয়ায় এককভাবে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা মধ্যপ্রাচ্যে আড়াই হাজারের মত কর্মী পাঠিয়েছে। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে এই এজেন্সি একাই ৮ হাজার ৫৯২ কর্মীর ছাড়পত্র নিয়েছে।
ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের এজেন্সি আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর দিক দিয়ে পঞ্চম অবস্থান রয়েছে। মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার খোলার আগে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না। বিদেশে পাঠিয়েছিল মাত্র ২৩৮ জন কর্মী। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে তারা শীর্ষ তালিকায় চলে আসে। এই এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় গেছেন ৭ হাজার ৮৪৯ জন কর্মী। ওই চক্র গঠনের সময় বেনজীর ছিলেন রিক্রটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ ও মেয়ে নাফিসা কামালের অরবিটালস ইন্টারন্যাশনালের নামে মালয়েশিয়ায় গেছেন মোট ৯ হাজার ৮৬১ জন। চক্র গঠনের সময় আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
সারসংক্ষেপে বলা হয়, তিন সংসদ সদস্য ও একজন সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যের এজেন্সির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং এ খাতের নতুন অনেক কোম্পানি বিপুলসংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ কর্মী পাঠায়। তবে বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশের ক্ষেত্রে এমন চক্র-ব্যবস্থা নেই। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত।
চক্রে থাকা এজেন্সিগুলো বসে বসে প্রতি কর্মীর বিপরীতে অন্তত দেড় লাখ টাকা 'চক্র ফি' পাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটে যুক্ত এজেন্সিগুলোর মধ্যে আরো আছে– ঐশী ইন্টারন্যাশনাল, নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেড, পিআর ওভারসিজ, সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল, ইম্পেরিয়াল ওভারসিজ, বিএম ট্রাভেলস লিমিটেড এবং অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সি।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার-নির্ধারিত ব্যয় জনপ্রতি ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে একজন বাংলাদেশি কর্মীকে গড়ে খরচ করতে হয় ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
দুদকের হাতে আসা অভিযোগ বলছে, দেড় বছরে সাড়ে ৪ লাখের মত লোক পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জনপ্রতি দেড় লাখ টাকা করে চক্র ফি হিসেবে নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। মাত্র দেড় বছরে চক্রে থাকা রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার লাখ শ্রমিক পাঠিয়ে ওই অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। মাত্র দেড় বছরে চক্রটি প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।
কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের অংশ হিসেবে শিগগিরই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে। পাশাপাশি কারসাজিতে জড়িতদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে।
“চক্রটি চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এই অনিয়মে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারে। শ্রমিকদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। বরং সিন্ডিকেট তৈরির রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে।”
বিভিন্ন অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া বন্ধ করেছিল মালয়েশিয়া৷ ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ফের বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রমিক নেওয়ার চুক্তি করে দেশটি৷ তখন শ্রমিক ভিসায় দেশটিতে যেতে সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার ৫৪০ টাকা ফি নির্ধারণ করে সরকার। ২০২২ সালে এক অফিস আদেশে এ খরচ নির্ধারণ করেছিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারের চুক্তির আওতায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০টি নির্ধারিত রিক্রুটিং এজেন্সি দেশটিতে শ্রমিক পাঠাত। তবে ২০২১ সালে নতুন একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া। ওই সমঝোতায় রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০টি করা হয়।
১০ এজেন্সির সিন্ডিকেট ভেঙে ১০০ এজেন্সিকে দায়িত্ব দেওয়া হলে সেখানেও তৈরি হয় নতুন সিন্ডিকেট। তাদের মধ্যে ২০-২৫টি এজেন্সির একটি সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে মালয়েশিয়ার কর্মী পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি।