Published : 12 Mar 2022, 01:31 PM
জীবনানন্দ দাশের সমধিক পরিচিত উক্তি 'সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি'-কে বিস্তৃত করে রফিক আজাদ বলেছেন, 'এই বঙ্গদেশে হাজার-হাজার লোক কবিতা লেখেন। সকলেই কি কবি? না, কেউ-কেউ কবি—এই অসংখ্যের মধ্যে।' কবিতা কখন এবং কিভাবে উত্তম কবিতা হয়ে ওঠে এবং ছন্দ আর অন্ত্যমিলের ঝকমকির প্রচণ্ড চেষ্টার পরও কেন অনেক লেখা আর কবিতা হয়ে ওঠে না, এইসব বিষয় ও বস্তু যখন মনে ভাসে তখন রফিক আজাদের একটি পঙক্তিকেই যথেষ্ট মনে হয়। তিনি মনে করতেন, 'যাদের অন্তর্দৃষ্টি আছে এবং অপারকল্পনা শক্তি আছে, সর্বোপরি ভাষা, ছন্দ, গঠন, প্রকৃতিসহ কবিতার সব গোপন ও প্রকাশ্য কলাকৌশল আয়ত্তে আছে; এবং প্রখর কাণ্ডজ্ঞান আছে—তাঁদের পক্ষেই কবি হওয়া সম্ভব, তাঁরাই কবি।'
বাংলা সাহিত্যের নিবিড় পাঠকমাত্রই জ্ঞাত রফিক আজাদ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রফিক আজাদ যে ভাষা সংগ্রামীও ছিলেন, অনেকে হয়তো এই ব্যাপারেও জ্ঞাত। এই ব্যাপারে যারা জ্ঞাত নন তাদের জ্ঞাতার্থে একটি তথ্য উল্লেখ করছি: মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হওয়া মানুষদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকে '৫২-র ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ রফিক আজাদ মিছিলে সারথি হয়েছিলেন। আমাদের ভাবতে শুধু বাধ্য করে তাই নয়, আমরা আন্দোলিতও হই যখন অনুভব করি, যে, তৃতীয় শ্রেণিতে পাঠরত একটি শিশু কোন সে বোধে আন্দোলিত হয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারির পরের তুমুল থমথমে অবস্থার দিন পরিবারের কঠিন শাসন অগ্রাহ্য করে নগ্ন পায়ে মিছিলে সারথি হন।
কবির বুকে শুধু বারুদের বাসা ছিলো তাই নয়, মানুষের প্রতি লালন করতেন গভীর মমতা। ফলে কবির দ্রোহী কলমের রক্ত টগবগিয়ে উঠে একদিন লিখেছিলো, 'ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।' আমাদের কমবেশি সকলেরই জানা, কার উদ্দেশ্যে আর কেনইবা রক্ত-টগবগ-করা এই পঙক্তির কামান নিক্ষেপ করেছিলেন কবি। অথচ, আজকাল কবিদের মুরোদ নিয়ে প্রায়শই খাবি খেতে হয়। এমনকি, রফিক আজাদের দুঃসাহসিক পঙক্তিটি উচ্চারণ করলেও কবিরা যেন অস্বস্তিতে পড়েন। সমসাময়িক কবিদের মধ্যে খুব কম কবি খুঁজে পাওয়া যায় যার কলম টগবগিয়ে বলবে, কোনো অন্যায় চলবে না। আমাদের এই ব্যাপারেও রফিক আজাদ জ্ঞাত করেন, যে, কবিদের দাস হতে নেই। কবিদের ভূখণ্ডে কবিরা হলেন স্বাধীন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবিরা তাদের মস্তক বন্ধক রেখেছে রাখুক, আমরা রফিক আজাদের 'ভাত দে হারামজাদা' কবিতাটি পাঠ করি:
'ভীষণ ক্ষুধার্ত আছিঃ উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে– প্রতিপলে- সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি- যেমন চৈত্রের শষ্যক্ষেত্রে– জ্বেলে দ্যায়
প্রভুত দাহন– তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ
দু'বেলা দু'মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোন দাবী
অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়:
বাড়ি, গাড়ি, টাকা কড়ি– কারো বা খ্যাতির লোভ আছে
আমার সামান্য দাবী পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-
ভাত চাই– এই চাওয়া সরাসরি– ঠান্ডা বা গরম
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ'লে
কোনো ক্ষতি নেই– মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাইঃ
দু'বেলা দু'মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য-সব দাবী;
অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা
চাইনিতো: নাভি নিম্নে পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক- যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও
জেনে রাখো: আমার ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ'টে যাবে
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন–
সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে:
থাকবে না কিছু বাকি– চলে যাবে হা ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে ধরো পেয়ে যাই–
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ'লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে।
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা,
তা না হলে মানচিত্র খাবো।'
রফিক আজাদের প্রকৃত নাম ছিলো রফিকুল ইসলাম খান। ডাকনাম ছিলো জীবন। অকাল প্রয়াত বড় বোন অনাগত ছোট ভাইটির নাম রেখেছিলেন জীবন। পারিবারিক 'খান' বংশের খানকে কবি শুধু খানখান করেননি, নিজের নাম পুরোপুরি পালটে ফেলে হয়েছেন রফিক আজাদ। রফিকুল ইসলাম খান বললে তাকে কেউ চিনবে বলে মনে হয় না। জীবনে কি করেননি মানুষটা! এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কবি না হলে হতেন পেশাদার খুনী। অথচ, পেশাদার খুনী না-হতে পারা কবির কবিতার ছত্রেছত্রে গভীর প্রেম পাওয়ার-দেওয়ার তীব্র অনুভূতি, আকাঙ্খা প্রভৃতি আপনা হতেই আমাদের অনুভূত হয়। বড় কাঙাল ছিলেন শুদ্ধতম ভালবাসা পাওয়ার, ভালবাসা দেওয়ার। ক্ষণিকের মানুষজন্মের আমাদের ভালবাসায় এত রক্ত-পুঁজ অনুভব করে কবি বিরক্ত হতেন। কবির হৃদয়ের গভীরতম দেশটির খোঁজ পাই আমরা কবির 'নগর ধ্বংসের আগে' কবিতাটির পঙক্তিতে:
নগর বিধ্বস্ত হ'লে, ভেঙ্গে গেলে শেষতম ঘড়ি
উলঙ্গ ও মৃতদের সুখে শুধু ঈর্ষা করা চলে।
'জাহাজ, জাহাজ' – ব'লে আর্তনাদ সকলেই করি –
তবুও জাহাজ কোনো ভাসবে না এই পচা জলে।
সমুদ্র অনেক দূর, নগরের ধারে-কাছে নেই :
চারপাশে অগভীর অস্বচ্ছ মলিন জলরাশি।
রক্ত-পুঁজে মাখামাখি আমাদের ভালবাসাবাসি;
এখন পাবো না আর সুস্থতার আকাঙ্খার খেই।
যেখানে রয়েছো স্থির – মূল্যবান আসবাব, বাড়ি;
কিছুতে প্রশান্তি তুমি এ-জীবনে কখনো পাবে না।
শব্দহীন চ'লে যাবে জীবনের দরকারী গাড়ি –
কেননা, ধ্বংসের আগে সাইরেন কেউ বাজাবে না।
প্রোথিত বৃক্ষের মতো বদ্ধমূল আমার প্রতিভা –
সাধ ছিল বেঁচে থেকে দেখে যাবো জিরাফের গ্রীবা।
[নগর ধ্বংসের আগে]
প্রেম, প্রকৃতি তাঁর কবিতায় নানাভাবে উঠে এসেছে। যদি ভালবাসা পাই কবিতাটিতেও আমরা যেন স্বয়ং কবির হৃদয়টিই দেখতে পাই। কবি বলেন: 'যদি ভালবাসা পাই আবার শুধরে নেব/ জীবনের ভুলগুলি/ যদি ভালবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘপথে/ তুলে নেব ঝোলাঝুলি/ যদি ভালবাসা পাই শীতের রাতের শেষে/মখমল দিন পাব/ যদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবো/আর সমুদ্র সাঁতরাবো/ যদি ভালবাসা পাই আমার আকাশ হবে/ দ্রুত শরতের নীল/ যদি ভালবাসা পাই জীবনে আমিও পাব/ মধ্য অন্তমিল।'
রফিক আজাদই তো জীবন, জীবনের আরেক নাম। জীবনকে আষ্টেপৃষ্টে তিনি ছুঁয়েছেন। অভিজাত পরিবারের সন্তান রফিক আজাদের বন্ধু ছিলো সুতার, ধোপা, দর্জি, চাষা প্রভৃতি মানুষজনের সন্তানরা। 'সংখ্যালঘু সম্প্রদায়'-এর ছেলেমেয়েরাই ছিল তাঁর শৈশব-কৈশোরের বন্ধু। বাস্তব জীবনে যতটা উদার এবং হেয়ালি-খেয়ালি ছিলেন কিন্তু কবিতার ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ সিরিয়াস। গদ্যে বা পদ্যে যে উপায়েই লিখিত হোক না কেন, কবিতাকে কবিতা হয়ে উঠতে হয়। এই ব্যাপারে তিনি বলেছেন, 'কবিতাকে কবিতা হতে হবে প্রথমত।' গদ্যে লিখিত হলেও সেটা কেন কবিতা এই প্রমাণটুকুর বাড়তি দায়িত্ব গদ্যকবিতা লেখা কবির ঘাড়ে বর্তায়, সে ব্যাপারটিও তিনি অনুল্লেখ রাখেননি। কবির 'চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া' কবিতাটি পাঠ করলে ব্যাপারটা বোধগম্য হওয়ার পাশাপাশি আমাদের মস্তিষ্কে প্রবাহিত হওয়া এক অলকানন্দার শান্ত স্রোতও কলকল বয়ে যাবে:
স্পর্শকাতরতাময় এই নাম
উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,
অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,-
চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে
খুব শক্তিশালী
মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।
চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ,
চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;
চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।
চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।
চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে উঠে কি?
প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে না-না ক'রে ওঠে?
— চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে।
বৃক্ষদের সাহচার্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রস্তাবে খুব সুখে আছে।
চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্যসমাজের
কারু-কারু মনে,
কেউ-কেউ এখনো তো পোষে
বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া।
চুনিয়া শুশ্রুষা জানে,
চুনিয়া ব্যান্ডেজ জানে, চুনিয়া সান্ত্বনা শুধু-
চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না;
চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয়- শান্তি ভালোবাসে,
কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে।
চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না।
রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে
চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ;
চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত
মারণাস্ত্রগুলো
ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে।
চুনিয়া তো চায় মানুষের তিনভাগ জলে
রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক।
চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলি
সুগন্ধি ফুলের চাষে ভ'রে তোলা হোক।
চুনিয়ারও অভিমান আছে,
শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে;
শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে-দেখে সেও
মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে।
চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে
নিশিদিন আশার পিদ্দিম জ্বেলে রাখে।
চুনিয়া বিশ্বাস করে:
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে
পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।
হিমেনেস বলেছেন, কবিতা ছাড়া তিনি কিছুই লিখতে জানেন না, এমনকি চিঠিও। ইংরেজ কবি অডেন কবিতাকে বলেছেন 'মেমোরেবল স্পিচ'। জীবনানন্দ দাশ কেন বলেছেন কল্পনাপ্রতিভার মহত্তম অভিব্যক্তি হলো কবিতা, রফিক আজাদের 'প্রতীক্ষা' কবিতাটি পাঠ করার কালে আমরা তা কিছুটা ঠাহর করতে পারি। কবিতার বৈশিষ্ট্য, ব্যাখা, রঙ-রূপ প্রভৃতি যেন এই কবিতাটির মধ্যেই পাওয়া যায়। স্যান্ডবার্গ-এর বলা কবিতা হচ্ছে প্রতিধ্বনি, একটা ছায়াকে নাচতে বলা। ছায়াকেই যেন নাচালেন আমাদের কবি তাঁর কবিতাটিতে:
এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব'লে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-
কোনো বন্ধুর জন্যে
কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো…
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব'সে আছি-
হয়তো কেউ বলেছিলো, "অপেক্ষা ক'রো
একসঙ্গে বেরুবো।"
এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি
কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো
উচ্চারণ করেছিলো, "বাড়ি থেকো
ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।"
হয়তো বা ওর মনের মধ্যে ছিলো
চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেস্ট বাংলো;
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি।
যুদ্ধের অনেক আগে
একবার আমার প্রিয়বন্ধু অলোক মিত্র
ঠাট্টা ক'রে বলেছিলো,
"জীবনে তো কিছুই দেখলি না
ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া। চল, তোকে
দিনাজপুরে নিয়ে যাবো
কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি,
বিরাট গোলাকার চাঁদ মস্ত খোলা আকাশ দেখবি,
পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি,
গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান
পেয়ে যেতেও পারিস,
তৈরী থাকিস– আমি আসবো"
–আমি অপেক্ষায় থেকেছি;
আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি- শত্রুর জন্যেও
অপেক্ষায় থেকেছি,
বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে
অপেক্ষায় থেকেছি-
কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো না,
-প্রতীক্ষা করবো।
'প্রতীক্ষা' শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্যে খুব যত্নে
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,
অভিধানে শব্দ-দু'টির তেমন কোনো
আলাদা মানে নেই-
কিন্তু আমরা দু'জন জানি
ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক,
'অপেক্ষা' একটি দরকারি শব্দ—
আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন,
অনেকের প্রয়োজন মেটায়।
'প্রতীক্ষা'ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,
ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য,
আমরা কি একে অপরের জন্যে প্রতীক্ষা করবো না ?
আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো
দাঁড়িয়ে থাকবো–
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ'রে যোগ্য পথিকের
জন্যে প্রতীক্ষমান,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে
আমার পায়ে শিকড় গজাবে…
আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না…
কালের পথ পরিক্রমায় জীবন ঘষে যারা আগুন জ্বেলেছেন, সেইসব আলোর পথযাত্রীদের একজন রফিক আজাদ। ২০১৬ সালের আজকের তারিখে কবি অলোকলোকবাস নিয়েছেন। উড়তে চাওয়া মানুষজীবন তাঁর জীবনতরী ছেড়ে অনন্তলোকবাস নিলেও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন বহুভাবে। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি আমাদের অন্যতম প্রধান কবিকে।