Published : 17 Feb 2011, 12:16 AM
মেহেরজান সিনেমার পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন
নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেন-এর 'মেহেরজান' সিনেমার প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয় ১৯ জানুয়ারি ২০১১। স্টার সিনেপ্লেক্সের দুটি হলে প্রিমিয়ার শো দেখানো হয়। ২১ জানুয়ারি থেকে সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া হয় মেহেরজান। মুক্তির সপ্তাহ খানেকের মাথায় 'মেহেরজান'-এর পরিবেশক প্রতিষ্ঠান 'আশীর্বাদ চলচ্চিত্র' সিনেমাটি হল থেকে উঠিয়ে নেয়।
মুক্তির এক সপ্তাহের মাথায় হল থেকে কোন একটি সিনেমা নামিয়ে দেওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সেটা হল কর্তৃপক্ষ নামায়। কিন্তু 'মেহেরজান'-এর ক্ষেত্রে হল কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তির মেয়াদ থাকা অবস্থায় এবং হল কর্তৃপক্ষের আগ্রহ থাকলেও পরিবেশক পক্ষ থেকে সিনেমাটি তুলে নেওয়া হয়। এটি বাংলাদেশের সিনেমা জগতে একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
'মেহেরজান' সিনেমার পোস্টার
'মেহেরজান' সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেয়ে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত হয়। কিন্তু মুক্তির পরে পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন ওয়েবসাইট, বাংলা ব্লগ ও ফেসবুকে ছবিটি ঘিরে সমালোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ আপত্তি জানিয়ে মানব বন্ধন করেন এবং পত্রিকা মারফতে প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করেন। সমালোচনার জবাবে ছবিটির নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেন পত্রিকার মাধ্যমে ছবিটির উদ্দেশ্য ও বিশ্লেষণ হাজির করেন।
আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। সমালোচকদের দাবি—'মেহেরজান' সিনেমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে আসা পাকিস্তানী সৈনিকের সাথে বাঙালি এক নারীর প্রেম সিনেমায় দেখানো মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা ঘটায় বলে বলা হয় এবং 'মেহেরজান' সিনেমা এই দোষে দুষ্ট বলে তীব্র আপত্তি আসে। বহু সমালোচনা, আপত্তি আসলেও ছবিটি নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবি ওঠেনি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র এক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান ধরা যেতে পারে। অর্থাৎ সরকারের পক্ষ থেকে কোন নিষেধাজ্ঞা না আসলেও পরিবেশক পক্ষ থেকেই ছবিটি নামিয়ে নেওয়া হয়।
মেহেরজান সিনেমার দৃশ্য
'মেহেরজান'—'একটি যুদ্ধ ও ভালোবাসার কাহিনী', এই যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভালোবাসা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন পুরুষ সদস্যের সাথে একজন বাঙালি নারীর ভালোবাসা। ছবিতে আরো এসেছে—১৯৪৭ সালের উপনিবেশোত্তর ভাগাভাগি, ধর্ষণ, বীরাঙ্গণা, সমকামিতার মতো প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে ছবিটির প্রতিক্রিয়ায় পরিষ্কার হলো যে, এই সিনেমা ও এর কাহিনী স্পর্শকাতর। হল থেকে সিনেমাটি তুলে নেওয়ার মাধ্যমে এক ধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলো।
এই প্রেক্ষিতে আর্টস-এর পক্ষ থেকে সিনেমাটি নিয়ে একটি বৈঠক আয়োজন করা হয়, বিডিনিউজ২৪.কম-এর ধানমণ্ডি কার্যালয়ে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে। এই সিনেমাকে কেন্দ্র করে আলোচকবৃন্দ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ, শিল্পকর্মের দায়-দায়িত্ব, ইতিহাস ও সিনেমার (শিল্পের) সম্পর্ক, নারীবাদ, পুরুষতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই বৈঠকের অডিও, ভিডিও এবং আলোচকদের বক্তব্য লিখিত আকারে আর্টস-এ প্রকাশিত হবে। লিখিত বক্তব্য অনলাইনে পড়া যাবে, ভিডিও দেখা যাবে এবং অডিও ডাউনলোড করে কম্পিউটারে বা এমপি৩ প্লেয়ারে শোনা যাবে। আর্টস-এর পাতায়ও সরাসরি অডিও শোনার ব্যবস্থা রাখা আছে।
'মেহেরজান' নিয়ে আয়োজিত বৈঠকে সঞ্চালক হিসেবে ছিলেন ব্রাত্য রাইসু। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন—
হাবিব খান (সিনেমাটির পরিবেশক ও আশীর্বাদ চলচ্চিত্রের প্রধান)
ফরহাদ মজহার (কবি, লেখক ও গীতিকার)
সলিমুল্লাহ খান (শিক্ষক, লেখক ও অনুবাদক)
পিয়াস করিম (শিক্ষক, লেখক)
মোরশেদুল ইসলাম (চলচ্চিত্র নির্মাতা)
জাকির হোসেন রাজু (চলচ্চিত্র সমালোচক ও নির্মাতা)
ফৌজিয়া খান (লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা)
সুমন রহমান (কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক)
ফাহমিদুল হক (শিক্ষক ও লেখক)
মোহাম্মদ আজম (শিক্ষক ও লেখক)
মুসতাইন জহির (লেখক)
বিভিন্ন ইস্যুতে আর্টস এ ধরনের বৈঠক নিয়মিত আয়োজন করবে এবং আর্টস-এ সেগুলো নিয়মিত প্রকাশ করা হবে।
বৈঠকের অডিও/ভিডিও ১
বি.দ্র. অডিও/ভিডিও ডাউনলোড করার জন্য নিচের ঠিকানা থেকে মজলিা ফায়ারফক্স অ্যাড-অন ইনস্টল করে নিন।
ফায়ারফক্স অ্যাড-অন: অডিও/ভিডিও ডাউনলোড অ্যাড-অন
অ্যাড-অন লিংক-এ ডাউনলোড করার নির্দেশনা দেওয়া আছে।
মেহেরজান বিতর্ক
অংশ ১
ব্রাত্য রাইসু: আমরা মেহেরজান নিয়া আলাপ শুরু করি তাইলে। পদ্ধতিটা হইছে যে, সবাইর কাছে আমরা কিছু জিজ্ঞেস করবো না। যার কিছু বলার বা আপত্তি থাকবে তারা হাত তুলবেন। প্রথমে আমরা হাবিব খান সাহেবকে বলবো যে উনি ওনার অভিজ্ঞতা এই সিনেমা নিয়া বলার জন্য। সব মিলাইয়া, এখন পর্যন্ত অবস্থা নিয়া।
বৈঠকে বক্তব্য রাখছেন 'মেহেরজান'-এর পরিবেশক হাবিব খান
হাবিব খান: সিনেমাটার যে ডিস্ট্রিবিউশন আমি নিছি—এটার খুব কমার্শিয়াল আসপেক্ট ভাইবা কিন্তু নেই নাই। আমি যে ডিস্ট্রিবিউশন করি আর কি—সেটা মোর অর লেস ইট'স নট এ কমার্শিয়াল ভেনচার, আমার ডিস্ট্রিবিউশন করার পেছনে একটা কারণ হলো—আমি সিনেমাতে অনেক দিন আছি, একটু ভালো ছবি, একটু অফ ট্র্যাকের ছবি হলে অনেকে রিলিজ করতে পারে না, আমার কাছে আসে, আমি ছবিটা করি। এই হলো আমার ডিসট্রিবিউশনের ধারা। এখন, বাকি কী, মানে এখন?
(ব্রাত্য রাইসু: এই যে হঠাৎ করে সিনেমাটা নামাইয়া দেওয়া হইলো—)
হাবিব খান: হঠাৎ করে সিনেমাটা… কোনোদিনও হঠাৎ করে নামেনি। প্রথম কথা হইল—ছয়টা হলে ছবিটা রিলিজ হইছিলো—আমরা নামাইয়া দেই নাই কিন্তু! প্রথম কথা হইলো—ওই এক সপ্তাহ পরে, শুক্রবার রিলিজ হবার পরে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যে রিক্যোয়ার্ড সেল তার কাছাকাছি না থাকার কারণেই নিয়মানুযায়ী ওরা ডিসকনটিন্যু করে আমাদের ভাষায়। এইটাও চারটা হল থিকা ডিসকনটিন্যু হয়েছে। আর দুইটা সিনেমা হলে—এই বলাকায় আমি প্রেসার করে রেখেছিলাম—থাকে না ওয়ান টু ওয়ান রিলেশনে—আর স্টার সিনেপ্লেক্সে ছিল, চলতে পারতো। দুইটা সিনেমা হলে ছবিটা চলার একটা… এবং বলাকাতে এই সপ্তাহেই চলতো, আর চলতো না। সিনেমা কিন্তু ওগুলো কিন্তু নামানো হয় নাই, ওগুলো কিন্তু এমনিই নাইমা গেছে।
(ব্রাত্য রাইসু: আচ্ছা, যেগুলো নামানো হইছে, সেইটা কোনটা তাইলে?)
সেইটা এখন ধরতে গেলে বলাকা আর স্টার সিনেপ্লেক্স।
(ব্রাত্য রাইসু: এটা কি আপনি নিজেই নামাইছেন?)
হ্যাঁ।
(ব্রাত্য রাইসু:কারণটা কী একটু বলবেন?)
হ্যাঁ বলবো।
(ব্রাত্য রাইসু: বলেন।)
আমি যখন ছবিটা রিলিজ করতে গিয়েছিলাম, ছবিটা দেখে আমার ব্যক্তিগতভাবে ভাল্লাগছে। আমার ভালো লাগার কারণেই আমি ছবিটা ডিসট্রিবিউশনে ইনভলভ হইছি, ভালো লাগার কারণে। ছবিটা রিলিজও করছি যে–রিলিজ যে করছি–সেখানেও কিন্তু আমার একটু কষ্ট করতে হইছে। কারণ আমাদের যে অ্যাসোসিয়েশন আছে—প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি, ওখানে–তুমি বোধহয় জানো– দুইটা ছবি রিলিজ হলে থার্ড ছবি রিলিজ হতে পারে না। আমি যখন এটা রিলিজ করতে গিয়েছি তখন প্রযোজক সমিতি থেকে এরা বললো যে—ভাই এটা কেমনে, এটা তো হবে না। তো আমি—রুবাইয়াত চাচ্ছিলো ছবিটা এই সময়ই রিলিজ হউক, ওর একটা খুব ইচ্ছা ছিল আর কি। আমি মোটামুটি আমার সমিতির আইন অমান্য করে কাজটা করেছি এবং ওদেরকে বলেছি যে—একটা সুবিধা নেই তোদের কাছ থেকে আমি। সেই সুবিধাটা হইল—দ্যাখ রে আমি ওদেরকে বলছি যে—দ্যাখ, আমি এখন সবচেয়ে, সমিতির মধ্যে সবচেয়ে, সিনিয়র ওয়ার্কিং প্রডিউসার, বয়সের দিক থেকে (বয়সের সুবিধা নেওয়া আর কি)। তো মনে কর, আমি এইটা করলাম–তোরা আমার বিরুদ্ধে ফাইন কর জরিমানা কর, যা খুশি তোরা কর, এইটা আমি করমুই!
তো ওরা বললো যে, আপনি একটা কাজ করলেই… আমাদের ইয়ে হবে না? আমি বললাম যে, তোরা দেখিস না। আমি তো অনেক হল নিচ্ছি না, আমি এই দুইটা হল নিবো–তোরা ই কইরা দে। তো ওরা বললো যে (এরাও তো সব আমার অনেক জুনিয়ার ছেলেপেলে, এছাড়া এতদিন… আমি ফিল্মে মোটামুটি আটিত্রশ বছর যাবৎ আছি–জাস্ট থার্টি এইট ইয়ার্স—তো এতদিন আমি… সমিতিও করতাম টরতাম—তো এরা—বাঙালিদের যা হয় আর কী, কিছু সম্পর্ক, কিছু এই সব মিলাইয়া আর কি!) তো এরা আইসা বলে, আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা দেখলাম না। ওরা দেখলো না। মানে আইনত তারা পারমিশন দিতে পারে না। তারপরও কিন্তু আমি ছবিটা এইভাবে করেছি, তার মানে প্রথম বুঝতে হবে যে ছবিটা রিলিজ করার জন্যে আমার এক্সট্রা অ্যাফোর্ট নিতে হইছে এই ছবিটা রিলিজ করার জন্যে। এই পর্যন্ত আমি ছবিটা রিলিজ করেছি, তারপরে দুইটা হল থেকে আমি ছবিটা নামাইয়া নিছি। এখন ছবিটা নামাইয়া নিছি কেন? আমি দেখলাম যে, আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব—যারা আমার সঙ্গে—
( ব্রাত্য রাইসু: বন্ধু-বান্ধবদের একটু নাম বললে…)
না নাম আমি বলবো না, যারা আমার বন্ধুবান্ধব আছে, যারা মানে, এক পর্যায়ে তো বন্ধুরা আমাকে একজনে রাজাকারই বললো!
(ব্রাত্য রাইসু: আপনার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু তাঁরা?)
'মেহেরজান' সিনেমার দৃশ্য
তারা আমারে রাজাকারও বললো… তো আমি বললাম হ্যাঁ, আমি রাজাকারই ঠিক আছে…। তো আর একজন আমাকে বললো যে—যখন প্রেস শোটা হলো, ওই যে প্রিমিয়ার হলো–আমাকে এক… আমি কারো নাম বলবো না… আমাকে এক বন্ধু বললো যে, আপনি ছবিটা রিলিজ কইরেন না। আমি বললাম, ঠিক আছে, করলাম না। কিন্তু আমার একটা ছোট্ট সমস্যা আছে, বলে–কী? আমি বললাম, আমি হলের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করছি একটা, আর একটা প্রোডিউসারের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করেছি, তো এই দুইটা আমি কী করবো? বললো, তাইলে তো অসুবিধা, তার পরে বললো যে, ঠিক আছে। তার পরে একজন ঢাকা ইউনিভার্সিটির একজন জুনিয়র লেকচারার—আমি নাম-টাম বলব না–আমারে ফোন দিছে, বলছে যে এইটা ঠিক না, দেখেন এই ঘটনা! তা আমি বললাম যে ভাই এক কাজ করো, তোমরা এইটারে দেইখো না। এটাকে তোমরা যদি ওভারলুক করো ছবিটা কিন্তু এমনিই কেউ নোটিস করবে না। আর তোমরা যদি এইটা নিয়া ঝামেলা করো তাইলে কিন্তু ছবিটা অনেক… বেশি আলোচনা হবে। একজাক্টলি তাই হইতেছে।
তারপরে তারা তো বললো যে মানববন্ধন করবে কী করবে, আমি বললাম দ্যাখো, এইটা করলে… ছবি কিন্তু এমনিই নাইমা যাইব, এক সপ্তাহে জানবও না লোকে! এই ধরনের ছবির ফেইট কী হয় আমি জানি। তারপরে তো আমি গেলাম একটু কোলকাতায়, শুনলাম যে ওখানে অলরেডি এখানে অনেক সমস্যা ক্রিয়েট হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখলাম যে একটা ছবি রিলিজ করে আমার এত বন্ধু-বান্ধব, এত সুহৃদ যারা আছে তাদের সঙ্গে রীতিমতো আমার… আমার ব্যক্তিগত ক্যাম্পও চেইনজ হয়ে যাচ্ছে, আমি বিশ্বাসটাও আমি মোটামুটি নাই আর কি এখানে। মানে টু সাম এক্সটেন্ট আমি আর এদিকে নাই–যেই বিশ্বাস নিয়ে ছিলাম। আমি বললাম, না ভাই, বিশ্বাসটা থাক তাইলে, আমি আমার জাগা থেকে লড়তে চাই নাই। সো, আমি এই জন্য ছবিটা নামাইছি!
(ব্রাত্য রাইসু: কোন দিকে?)
মানে যেই দিকে—আমাকে রাজাকার বানাইতে চাইছিল আমি ওইদিকে থাকতে চাই নাই। তো দেখলাম যে—আমি যেখানে ছিলাম আমি ওখানেই থাকি।
(ব্রাত্য রাইসু: কোন দিকে?)
মানে যেই দিকে… আমাকে রাজাকার বানাইতে চাইছিল আমি ওইদিকে থাকতে চাই নাই। তো দেখলাম যে—আমি যেখানে ছিলাম আমি ওখানেই থাকি।
(ব্রাত্য রাইসু: তাইলে আপনি আপনার মুক্তিযোদ্ধাত্ব বা ঐটা রক্ষা করার জন্যই এইটা নামাইছেন?)
কথাটা বোঝেন, এত কথা শোনার মতো আমার ই নাই, আমি দেখলাম যে আমি কী করবো? আমি এটা নিতে পারি নাই। আমার কাছে খুব ভালো লাগে নাই। এত লোক অসন্তুষ্ট হচ্ছে কেন? তাইলে আমার দেখাটা ভুল। আমিও তো, আমি নিজেও তো ভুল হইতে পারি। আমি দেখলাম যে—তাইলে বোধ হয় আই হ্যাভ ডান সামথিং রং! ও [মোরশেদুল ইসলামকে দেখিয়ে] একটু আগে আমাকে আন-অফিশিয়ালি জিজ্ঞেস করছে ছবিটা আপনি দেইখা নেন নাই। আমি বললাম, দেইখা নিছি! তো বলে, দেইখা নিলে নামাইলেন ক্যান? এই প্রশ্ন তো আমি নিজেরেও করতেছি এখন। আমি যদি জানতাম যে, এই প্রশ্ন আমারে করবে, তাইলে তো আমি ছবি রিলিজই করি না।
২.
ব্রাত্য রাইসু: তো এখন এই ছবির ব্যাপারে আমি প্রথম বলবো যে—আপনাদের যাদের আপত্তি আছে বা দেখার ক্ষেত্রে মনে করেন যে এই ছবির কাহিনীর মধ্যে বা এটার যে উপস্থাপনের মধ্যে আপত্তি আছে—সেইগুলি যদি বলেন আপনারা, যিনি বলতে চান প্রথমে, কে বলবেন?
বক্তব্য রাখছেন মোরশেদুল ইসলাম
মোরশেদুল ইসলাম: আমি বলি তাইলে।
(ব্রাত্য রাইসু: হ্যাঁ বলেন। মোরশেদ ভাই, নামটা বইলা নিয়েন।)
আমি মোরশেদুল ইসলাম, চলচ্চিত্র নির্মাতা। আপনার সঙ্গে হাবিব ভাই আমার, ছবির প্রিমিয়ার শোর পরের দিনই সম্ভবত কথা হইছে টেলিফোনে। তখন আমি ভুলে গেছি, ফোন রেখেই মনে হইছে যে আমি হাবিব ভাইকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করবো ভাবছিলাম, করলাম না কেন—যে কেন আপনি ছবিটা রিলিজ করলেন? মানে আমার কথা সেইখানেও থাকতো যে ছবিটা কেন আপনি রিলিজ করলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে? কিন্তু ছবিটা যখন রিলিজ করলেন, তখন কিন্তু সেটা আবার নামানো—আমি সেটার বিরোধিতা করি। এটা আমি বলে নিচ্ছি, সবাইকেই। আমার স্ট্যান্ড আর কি—যদি সেন্সর বোর্ডও ছবিটা নিষিদ্ধ করতো, আমি একইভাবে প্রতিবাদ করতাম। কিন্তু ছবিটার ব্যাপারে আমার যেটা বক্তব্য—হচ্ছে যে, আসলে বিতর্কগুলো আসছে সেগুলি খুবই—মানে বিভিন্ন রকমের বিতর্ক আসছে। এবং আমাদের একই মানসিকতার লোকজন আবার কেউ পক্ষে বলছে, কেউ বিপক্ষে বলছে।
(ব্রাত্য রাইসু: এটা—'একই মানসিকতা'টা কী একটু বলবেন?)
একই মানে, যারা নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে–আমি মনে করি। তাদের অনেকেই আবার এটার পক্ষেও যুক্তি দেখাচ্ছে। যেমন আমি ফাহমিদুলের লেখাটাও পড়লাম। যদিও লেখাটা খুবই জ্ঞানগর্ভ লেখা—খুব একটা আমি বুঝতে পারি নাই।
আচ্ছা এখন, আমার বক্তব্য হচ্ছে ছবিটার বিষয়ে, ছবিটা খুবই দুর্বল ছবি–মেকিং খুবই দুর্বল, চিত্রনাট্য খুবই দুর্বল, চরিত্রগুলোও খুব দুর্বল। এবং অভিনয় অংশ তো খুবই দুর্বল। মানে মেইন কাস্টগুলো ছাড়া বাকি চরিত্রগুলোর অভিনয় খুবই দুর্বল। এখন কনটেন্ট নিয়ে যদি আমি বলি—এখন মূল যে কনটেন্ট নিয়ে সবাই আলোচনা করছে—এইটার ব্যাপারে আমার খুব একটা আপত্তি নাই। তারপরও আমি বলবো যে, ধরেন এই যে মেয়েটা—মানে একজন পাকিস্তানি আর্মির সাথে একজন বাঙালির মেয়ের প্রেম। এখন সেই পাকিস্তানিটাকে তো কিন্তু সেই পজিটিভ ওয়েতেই দেখানো হয়েছে। পাকিস্তানি সোলজারটাকে। সে তার বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে পক্ষ ত্যাগ করেছে, এক অর্থে, দেখছি। তো এইটা তো খুবই—ঠিকই আছে। এবং আমরা কিন্তু বিভিন্ন ছবিতে দেখি, পৃথিবীর বিভিন্ন ছবিতে দেখি… যুদ্ধ নিয়ে যেসমস্ত ছবি হয়েছে—বহু ছবিতে এই বিষয়টা এসছে, মানবিক ব্যাপারটা এসছে, ইন্ডিয়ান ছবিও আছে—ভীরজারা যদি বলেন বা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের উপর অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত ছবি হয়েছে, যেইখানে আমরা শত্রুপক্ষকে দেখি যে এইরকম।
এখন সেই ছবিগুলোকে কিন্তু আমরা বলি তখন 'যুদ্ধবিরোধী ছবি' এবং যুদ্ধবিরোধী মানবতার ছবি আর কি। যুদ্ধবিরোধী ছবি মানেই কিন্তু মানবতার ছবি, কারণ যুদ্ধকে আমরা সবাই অপছন্দ করি, যে কোনো যুদ্ধ–দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বলেন বা পাকিস্তান-ইন্ডিয়ার যুদ্ধ বলেন। সেটা আমরা অপছন্দ করি বলেই যুদ্ধবিরোধী ছবি আমরা পছন্দ করি কিন্তু যুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধ এক জিনিস না। ঠিক আছে? মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে এমন একটা যুদ্ধ যেটা আমরা প্রয়োজনের তাগিদে করি এবং যেটা না করে আমাদের উপায় নাই–মুক্তির জন্য যুদ্ধ। সুতরাং যুদ্ধবিরোধী ছবিতে এই ধরনের বিষয় আসতে পারে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে এই ধরনের বিষয় আসলে আমরা সেটাকে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছবি বলবো, সহজ কথায়। আচ্ছা, এখন কথা হচ্ছে যে, এই ধরনের ঘটনা কি ঘটে নাই। ঘটেছে হয়তো, বাংলদেশেও ৭১-এ হয়তো দু /চারটা বিরল উদাহরণ আমরা খুঁজলে হয়তো পাবো। কিন্তু, সেগুলো কিন্তু বিরল, সেগুলো হচ্ছে–মানে ব্যতিক্রম। এখন আমরা ছবিতে কী দেখাবো–আমরা কি এই ব্যতিক্রমগুলো আমরা হাইলাইটেড করবো কি না এইটা হচ্ছে বিষয়। ঠিক আছে? তো সেইটা আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে করা উচিৎ না। সেই জন্যেই হয়তো ছবিটা নিয়ে বিতর্ক বেশি হচ্ছে। কিন্তু আমি আবার এটাও বলবো যে, এখনকার প্রজন্ম কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে দেখছে, বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছি, আমাদের যেই দেখার মধ্যে যে আবেগ—সবকিছু আছে তারা কিন্তু অনেকটা নিরাবেগভাবে, অনেকটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে, নানাভাবে বিশ্লেষণ করবে–এইটাই খুব স্বাভাবিক। সুতরাং তার ছবিতে এই জিনিসটাও আসতে পারে, আমরা তো আসবে না আসবে না করে কতদিন আর, আসতেই পারে! সেখানেও আমার আপত্তি নাই, যদি, অন্য বিষয়গুলোতে যদি, ছবির অন্য বিষয়গুলোতে যদি মুক্তিযুদ্ধকে মহিমান্বিত করা হতো। বা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবটাকে যদি প্রকৃত অর্থে তুলে ধরা যেত, তাহলে এই ব্যতিক্রম বিষয়টাও আমরা মেনে নিতাম, দর্শক হিসেবে। সেইখানেও পরিচালক কিন্তু ফেইল করেছেন এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে ফেল করেছেন।
'মেহেরজান' সিনেমার দৃশ্য
আমরা যদি লক্ষ করি—যে—ছবিতে টোটাল মুক্তিযুদ্ধকেই, মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে আমরা একেবারেই খুঁজে পাইনি, আমরা যারা—মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের কিছুটা যাদের আছে। যেই গ্রামটা দেখানো হইছে—সেই তিনটা মেয়ে—তারা যেই আচরণ করছে বা সেই ভিক্টর ব্যানার্জি যে চরিত্রটা করছে—সেই চরিত্রটা তো—চরিত্রটাই কী সেটাই বোঝা গেল না কিছু, তাই না? এই সব মিলিয়ে এবং যে, গ্রামের যে আবহ সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে রিপ্রেজেন্ট করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো এরকম ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা যে দু'এক জনকে দেখানো হয়েছে ছবিতে—সেই দুইটা চরিত্রকেই কিন্তু অনেক ইয়ে করা হয়েছে মানে সেই চরিত্রগুলো কিন্তু—মানে কী বলবো—সেই চরিত্রগুলো খুবই দুর্বল। একজন যেমন মার কাছে বলে যাচ্ছে যে—আমি যুদ্ধ করতে যাই, মা। মা কান্নাকাটি করছে—না যাইস না!
এই ধরনের ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটেনি কিন্তু যে, মার কাছে বলে যাচ্ছে এবং মা কান্নাকাটি করছে। হয়েছে কখন—হয়েছে—মাকে বলে গেছে যখন মাও ছেলেকে উদ্বুদ্ধ করেছে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। আর নতুবা করেছে কী—চিঠি লিখে হয়তো গেছে। আচ্ছা, তারপরে আবার গেল যুদ্ধে, মাঝপথে আবার ফিরে আসলো–কী বলছে ডায়লগে যে, 'যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত' তার মানে বিয়ে করতে চাচ্ছে, যুদ্ধের সময়ই। তো মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রগুলোকে খুবই…
(ব্রাত্য রাইসু: আদর্শ চরিত্রগুলা?)
হ্যাঁ–হ্যাঁ—সেগুলোকে খুবই ইয়ে ভাবে দেখানো হয়েছে। এটা হচ্ছে আমার প্রথম অবজার্ভেশন। তারপরে ছবির যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্র হচ্ছে–যেই মেয়েটা ধর্ষিতা হলো। এখন যেই মেয়েটা ধর্ষিতা হলো তার চরিত্রকে কিন্তু খুবই–মানে কীভাবে পোট্রে করেছে দেখেন। তার চরিত্র দেখার পর একজন দর্শক হিসেবে আমার কিন্তু তার প্রতি বিন্দুমাত্র সিমপ্যাথি বা শ্রদ্ধাবোধ জাগে নাই– একজন বীরাঙ্গনা হিসেবে। তার যে চালচলন, পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে এভরিথিং–সবগুলোতেই সেই চরিত্রটা কিন্তু… এখন পরিচালক হয়তো বলছে বা এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বলবে হ্যাঁ আমরা যারা ধর্ষিতা হয়েছে তাদের সবসময় দেখে এসেছি নরমভাবে দেখাতে, সেটা না, আমাদের চরিত্রটা অনেক স্ট্রং দেখাতে চেয়েছি আমরা ইত্যাদি ইত্যাদি। স্ট্রং মানে কিন্তু বা আধুনিকতা মানে কিন্তু এই নয় আর কি। এবং সে আর একবার বলছে যে ছাত্র ইউনিয়ন করত সে এবং তার এই অভিজ্ঞতা এই প্রথম না—তাই না? এগুলো কী! এগুলো কেন এসছে বা কী জন্য এসছে? এটা করে কিন্তু তাকে যে, সে যে রেইপ্ট হলো পাকিস্তানী আর্মি দ্বারা—সেই জিনিসটাকে আরো নরম মানে হালকা করে ফেলা হলো। এবং সেই চরিত্রটাও আমাদের মনে কোনো দাগ কাটতে পারে নি এবং সেই চরিত্রটা এবং বীরাঙ্গণা—প্রকৃত অর্থে যারা বীরাঙ্গণা আমাদের তাদের প্রতি মানুষকে, বর্তমান প্রজন্মকে ভুল বার্তা দেবে… বা তাদেরকে হেয় করা হয়েছে বলে আমি মনে করি।
তো এই সব মিলিয়ে আমার কাছে ছবিটা আপত্তিকর মনে হয়েছে, আমি যদি বলি আপত্তিকর—
ভিডিও ধারণ ও অনুলিখন: প্রমা সঞ্চিতা অত্রি
—
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts