বরেণ্য লেখক ও অনুবাদক অর্ক দেব এই গ্রন্থ অনুবাদের মাধ্যমে নিছক অনুবাদক হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেননি, একই সঙ্গে সংগ্রামী কিন্তু অত্যাচারিত এই জাতিগোষ্ঠীর প্রতি তার সহৃদয় সমর্থনকেও পরোক্ষে তুলে ধরেছেন।
Published : 17 Apr 2024, 02:49 PM
ইহুদিদের দ্বারা ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইলি রাষ্ট্র ঘোষণার আগে থেকেই ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা শুরু হয়েছিল। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের একটি জাতীয় আশ্রয়স্থল গড়ে তুলতে বেলফ্যুর প্রস্তাবনা সামনে নিয়ে আসে, এক অর্থে তখন থেকেই স্বাধীন ফিলিস্তিনিদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের শুরু হয়। আর এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা। ফিলিস্তিনি লড়াকু কিশোরী আহেদ তামিমি রচিত ওরা আমায় সিংহ বলত শীর্ষক আত্মজীবনীতে ফিলিস্তিন নিয়ে ইহুদিবাদ ও ইউরোপিয় ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে তার সাবলীল ভাষায় ও বর্ণনায়। তথ্য উপাত্ত এবং ঐতিহাসিক ঘটনাপুঞ্জের সমাবেশে তামিমি এটিকে কেবল আত্মজীবনীর ব্যক্তিগত ভাষ্য হিসেবেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি, এটিকে করে তুলেছেন এক ঐতিহাসিক দলিল। ঠিক এই কারণে এটি আসলে যতটা না আত্মজীবনী, তারচেয়ে বেশি এক প্রত্যক্ষদর্শীর ইতিহাসগ্রন্থ। শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই নন, তিনি ঐতিহাসিক ঘটনারও এক কুশীলব। তাছাড়া, কেবল তামিমিই নন, মুক্তি সংগ্রামে তার পরিবারের অংশগ্রহণের বয়ানও এই ইতিহাসগ্রন্থের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
মূল বইটি They Called Me a Lioness শিরোনামে ইংরেজিতে বেরিয়েছিল ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর One World প্রকাশনী থেকে। আহেদ তামিমির সাথে এই গ্রন্থে দেনা তাকরুরি এর সহলেখিকা। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য লেখক, সাংবাদিক, গবেষক ও অনুবাদক অর্ক দেব। এই গ্রন্থের অনুবাদক অর্ক দেবের আরেকটি বিশেষ পরিচয় নজরুল-গবেষক হিসেবেও। অর্ক দেবের অনুবাদের বিশেষ গুণ হচ্ছে এই যে তা মূলের সাথে যেমন প্রতারণা করে না, তেমনি উদ্দিষ্ট ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে বাংলা ভাষার সাবলীলতাকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখেন। এর ফলে অনুবাদ হয়ে উঠেছে সুপাঠ্য। এই বইয়ের অংশবিশেষ যখন ধারাবাহিকভাবে এই বিভাগে প্রকাশিত হয়েছিল তখন বিপুল সংখ্যক পাঠকের কাছে বইটির বিষয়গুণের কারণে যেমন, তেমনি অনুবাদের এই আকর্ষণীয় গুণের কারণেও আদৃত হয়ে উঠেছিল। উভয় বাংলার পাঠকদের কৌতূহল ও তারিফের প্রতি সাড়া দিয়ে বৈভাষিক প্রকাশনী এই বছরের একবারে সূচনাতেই কোলকাতার জানুয়ারি বইমেলায় বইটির পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশ করেছে।
বইটিতে মোট ‘মেয়েবেলা’, ‘যাত্রাশুরু’,‘ নিষিদ্ধজমিন’, ‘বাঁধ ভেঙে যায়’, ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’, ‘চড়ের মাশুল’, ‘জেলখানা’, ‘ঘরেফেরা’ এবং ‘পুনশ্চ’ শীর্ষক নয়টি অধ্যায় আছে। প্রতিটি অধ্যায় ব্যক্তি ও পরিবারের সঙ্গে কিভাবে একটি রাষ্ট্রের ইতিহাসের সংগ্রামী পর্ব জড়িয়ে আছে তা সুখপাঠ্য এই বইটি না পড়লে বুঝা যাবে না। ফিলিস্তিনের সংগ্রাম নিয়ে বাংলায় ইতিমধ্যে অনেক বই বেরিয়েছে--যার কিছু গবেষকদের গবেষণা ও বিদেশি বই পাঠের ফল, আর অন্য কিছু বই যা মূলত বিদেশি লেখকদের বইয়ের অনুবাদ। কিন্তু এই বইটির বিশেষত্ব হচ্ছে সরাসরি সংগ্রামে জড়িত এক ফিলিস্তিনির অভিজ্ঞতা, উপরন্তু এক নারীর চোখে দেখার অভিজ্ঞতা-- এরকম সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। তামিমি তার জাতির মুক্তির জন্য এই অল্পবয়সেই যেভাবে সংগ্রামে জড়িয়ে অত্যাচারিত হয়েছেন, জেলজুলুম সহ্য করেছেন তা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অত্যাচারিত ইহুদীদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। অথচ ইতিহাসের কী নির্মম কৌতুক-- এক সময় যারা ছিল অত্যাচারিত আজ তারাই অত্যাচারী! আর ইতিহাসের ট্রাজেডি হচ্ছে এই যে তারা আজ অত্যাচারী তাদেরই আশ্রয়দাতা ফিলিস্তিনিদের উপর। তামিমি ও তাকরুবি রচিত এই আত্মজৈবনিক ইতিহাস গ্রন্থটি পাঠক হিসেবে আমাদের ধারণাকে যেমন স্বচ্ছ করে তুলবে, তেমনি এনে দেবে এক পরিপূর্ণতা। বরেণ্য লেখক ও অনুবাদক অর্ক দেব এই গ্রন্থ অনুবাদের মাধ্যমে নিছক অনুবাদক হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেননি, একই সঙ্গে সংগ্রামী কিন্তু অত্যাচারিত এই জাতিগোষ্ঠীর প্রতি তার সহৃদয় সমর্থনকেও পরোক্ষে তুলে ধরেছেন। অর্ক দেব যে নিছক অনুবাদের জন্য অনুবাদ করেন না, অনুবাদকেরও যে একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস, রুচি ও অভিমুখ থাকে, অর্ক সেই দিকটিকেই আরও স্পষ্ট করে তুলেছেন এই অনুবাদের মাধ্যমে। অর্ক দেবকে এই কারণে আমি একজন যোদ্ধা বলবো। এক অনুবাদক-যোদ্ধা। কৃতজ্ঞতা জানাই অর্ককে তার এই কাজের জন্য। ধন্যবাদ জানাবো বৈভাষিক প্রকাশনীর কর্ণধার মাধবী মজুমদারকেও যিনি এই কুরুক্ষেত্রের আরেক সহযোদ্ধা। দুইশ তিরিশ পৃষ্ঠার এই সুমুদ্রিত বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সাদিক হোসেন, আর সুন্দর অঙ্গসজ্জা করেছেন রাভেলী বিশ্বাস। ভারতীয় মুদ্রায় বইটির দাম ধার্য হয়েছে ৪৫০ রূপী। আমি নিশ্চিত ফিলিস্তিন ও ইসরাইলি সংঘাতের ইতিহাস সম্পর্কে যারা আগ্রহী তাদের কাছে বইটি আদৃত হবে।