যাই হোক, কাসাসের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম এবং কয়েকদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের প্রথম জনসম্মুখে বক্তৃতাও দিলাম।
Published : 28 Apr 2024, 12:34 PM
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার আরবেলিয়া গ্রামে শাক্ত ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্য পরিবারে ১৮৮৭ সালে জন্ম নরেন্দ্রনাথের যিনি পরে এম এন রায় হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সমধিক পরিচিতি উদার মানবতাবাদের (radical humanism) তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা হিসেবে। বিপ্লবী জীবনে তাঁকে বহু ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি প্রয়াত হন এই মনিষী।
মেক্সিকো সফর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এক অর্থে তার রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও মানবেন্দ্রনাথের মেক্সিকো-সফর বড় ধরনের বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর স্মৃতিকথা Memoirs ১৯৬৪ সালে দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। ৬২৮ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ স্মৃতিকথার শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মেক্সিকো বাসের রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল স্মৃতি। মূল গ্রন্থের ৫ম অধ্যায় থেকে ২৯ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সেই স্মৃতিচারণ। স্মৃতিকথার এই নির্বাচিত অংশ কলামিস্ট অনুবাদক প্রিসিলা রাজ-এর অনুবাদে ধারাবাহিকভাবে বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আজ থাকছে মেক্সিকো সফরের দ্বাদশ পর্ব। এই অনুবাদে মূল বইয়ের পর্ব-বিন্যাস অনুসরণ ও উল্লেখ করা হয়েছে।
মেক্সিকোতে আসার পর প্রথমে যে কাজগুলো করেছিলাম তার মধ্যে ছিল স্প্যানিশ শিক্ষকের কাছে ভাষা শিখতে শুরু করা। এল পুয়েবলোর সম্পাদক এক প্রবীণ শিক্ষকের কথা বলেছিলেন। ভদ্রলোক এসকুয়েলা নাসিওনালে পড়াতেন। তাঁর পদবী ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের সমমানের। কিন্তু মেক্সিকোতে উচ্চবিদ্যালয়কে বলে কলেহিওস বা কলেজ আর তাদের শিক্ষকদের প্রফেসর বা অধ্যাপক বলা হয়। অন্যদিকে কলেজকে বলে এসকুয়েলা অর্থাৎ স্কুল। স্কুলের কেবলমাত্র বিভাগীয় প্রধানকে বলা হয় মায়েস্ত্রো। ফলে আমার স্প্যানিশ শিক্ষকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদবী না থাকলেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের সমপর্যায়ভুক্ত ছিলেন। স্বল্পআয়ের খুবই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ভদ্রলোকের চিন্তাভাবনাও বেশ পুরানো ধাঁচের। ঘুরেফিরে (পোরফিরিও) দিয়াস আমলের স্বর্ণালী দিনগুলোর কথা বলতেন। বিপ্লব পরবর্তী ধ্বংসলীলা এবং বাড়াবাড়ি চাকচিক্য দুটো নিয়েই দুঃখ করতেন। তবে দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ভদ্রলোকের মধ্যে একধরনের দার্শনিক উদাসীনতা ছিল। রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ নেই। বিপ্লবী নেতৃত্ব সম্পর্কেও তাঁর ধারণা খুব উচ্চ নয়।
বিশেষ করে ওনার দুঃখ ছিল দেশের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় নিয়ে। সেটা বোঝাতে উনি মাঝপথে নির্মাণ থেমে যাওয়া অপেরা হাউজটার কথা বলতেন। ইউরোপীয় ধনীদের কালচার অনুসরণ করে গ্র্যান্ড অপেরা ও বিভিন্ন ব্যালে ট্রুপ প্রতিবছর শীতে মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠান করে যেত। রাজধানী শহরের মর্যাদা বাড়াতে তাই দিয়াস তাঁর শাসনের শেষদিকে ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ অপেরা হাউজগুলোর সঙ্গে তুলনীয় একটি অপেরা হাউজ বানাতে এক কোটি পেসো বরাদ্দ করেছিলেন। স্থপতি ও দক্ষ শ্রমিকদের ইতালি থেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু মার্বেলের সেই গর্বিত কাঠামো অর্ধেক শেষ হওয়ার আগেই বিপ্লব এসে পড়ে। আমি যখন এই শহরের বাসিন্দা ছিলাম তখনও নগরের কেন্দ্রে একটা পার্কের ভেতর অসংখ্য ভারার জঙ্গলের মধ্যে বিল্ডিংয়ের কাঠামোটি দণ্ডায়মান ছিল। দিয়াস আমলের বিগত রোশনাইভরা দিনের স্মারক ছিল শেষ না হওয়া এই ইমারত। গ্র্যান্ড অপেরা ও ব্যালের দল মেক্সিকোতে আর আসত না।
অন্যদিকে, জাতির দারুণ প্রিয় বুলফাইট বা ষাঁড়ের লড়াইও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কাররান্সা সরকার আসার পর থেকে। যুক্তিটা হচ্ছে, বুলফাইট নিষ্ঠুর ও বর্বর। দিয়াসের সময়ই নির্মিত মেক্সিকো সিটির বুলফাইট রিং যেটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুলফাইট রিং, সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বৃত্তাকার স্টেডিয়ামটির ধারণক্ষমতা ছিল ৩৫ হাজার। অপেরাহাউজের নির্মাণ শেষ না হওয়াকে সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায় হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু বুলফাইট নিষিদ্ধ ঘোষণা ছিল সত্যিকার অর্থে বিপরীত পথে যাত্রার স্মারক। আমার শিক্ষকের মতো এক শ্রেণীর মানুষ কুঁড়ে ধনীদের দল এবং তাদের বিলীয়মান গৌরবের কথা ভেবে সর্বদা বিলাপ করতেন। দেশে নতুন এক গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে তার বিপুল সম্ভাবনা তাদের চোখে পড়ত না।
১৯১৮-এর শুরুর দিকে বুলফাইটের বিরাট রিংটাকে উপযুক্ত কাজে লাগানো হলো। বোঝা গেল দিয়াসের নেতৃত্বে অর্জিত সাংস্কৃতিক উৎকর্ষকে ধ্বংস করতে আসেনি বিপ্লব। মেক্সিকো সিটিতে আবারও ইতালিয়ান গ্র্যান্ড অপেরা ও রুশ ব্যালে ট্রুপের আগমন ঘটল। অপেরা হাউজটির নির্মাণকাজ সময়মতো শেষ করা যায়নি। কিন্তু বিপ্লবী সরকার সাধারণ মানুষকে শিল্প উপভোগের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চায়নি। এজন্য ষাঁড়ের লড়াইয়ের মঞ্চ খুলে দেওয়া হলো। বিশাল গ্রীক স্টেডিয়ামে ঠাসা তিরিশ হাজারের ওপর দর্শক কয়েকদিন ধরে কারুসোর সঙ্গীত পরিবেশনা উপভোগের সুযোগ পেল। মানুষের কণ্ঠস্বর যে এমন হতে পারে কল্পনাতেও ভাবিনি। কারুসোর রাজসিক কণ্ঠে সঙ্গীতের অভিজ্ঞতা নেওয়ার পর পাভলোভার নাচ ও পুরো রুশ ব্যালে দলের পরিবেশনাকে রীতিমতো পানসে ও খামখেয়ালি বলে মনে হতে লাগল আমার। বলা বাহুল্য, মহৎ শিল্প সম্বন্ধে আমার মতামত তখনও একেবারেই আদিম পর্যায়ে।
পেশিবহুল পুরুষমানুষের অন্তর্বাস পরে সারা মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানোর মধ্যে শিল্প কোথায় সেটা বোঝার মতো আক্কেল তখনও তৈরিই হয়নি আমার। মনে হয়েছিল ওটাকে চৌকস জিমনাস্টিকস বলা যেতে পারে বড়জোর। আর সেটার জন্য সার্কাস দেখতে গেলেই তো হয়। সেখানে বরং আরো চমৎকার সব কৌশল দেখা যায়। সত্যি বলতে, ব্যালের ব্যাপারে আমার শিল্পবোধ আজও তেমন ধারালো হয়ে উঠতে পারেনি। একমাত্র রুশ অপেরাগুলোর ব্যালেতেই তৃতীয় অঙ্ক নিরুদ্বেগে পার করতে পারি। আর সেটাও সম্ভব হয় পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর করে ভেসে বেড়ানো মহিলা ব্যালেরিনার জন্য নয়। মূলত সঙ্গীত ও এর সব অনুষঙ্গ মিলিয়ে যে একটা ঝাকানাকা ব্যাপার তৈরি হয় সেটাই মুগ্ধ করে আমাকে।