চিনে রবীন্দ্রনাথের নতুন জীবনী
Published : 05 May 2024, 08:55 PM
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চীন সফরের একশতম বছর বেশ জোরে শোরেই পালিত হচ্ছে। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চীন সফর করেন। তিনি সেখানে প্রায় দু’মাস ছিলেন। সেই সময় থেকেই মূলত চীনে রবীন্দ্র চর্চা শুরু। রবীন্দ্রনাথকে চীনা ভাষায় ‘থাইকার’ নামে অভিহিত করা হয়। ঠাকুর থেকে থাইকার। চীনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক বই আলাদাভাবে চীনা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। এরই সাম্প্রতিকতম সংযোজন হলো বড় আকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরেকটিজীবনী গ্রন্থ প্রকাশ। বইটির নাম ‘বায়োগ্রাফি অব টাগোর: হিউমিলিটি অ্যান্ড গ্রেটনেস’। ‘রবীন্দ্রজীবনী: নম্রতা ও মহত্ত্ব।’ বইটি লিখেছেন চীনের বিখ্যাত বাংলাভাষা বিশেষজ্ঞ পাই খাই ইউয়ান (Bai Kai Yuan)। এই বইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের এমন অনেক তথ্য সংযোজিত হয়েছে যা বহুল পঠিত নয়। রবীন্দ্রনাথের চীন সফরের অনেক তথ্য এখানে রয়েছে যা এর আগে বাংলা বা ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়নি। বইটি চীনা ভাষায় লেখা হয়েছে। চীনে রবীন্দ্রচর্চার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও এখানে উঠে এসেছে যা রবীন্দ্র গবেষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।বইটির বিষয়বস্তু হলো চীনা জনগণের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা এবং কবিগুরুর প্রতি চীনের মানুষের অকুণ্ঠ প্রীতি ও শ্রদ্ধা। সেই সঙ্গে চীন ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদানে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা।
বইটি প্রকাশ করেছে হ্যনান লিটারেচার অ্যান্ড আর্ট পাবলিশিং হাউজ। বইটির লেখক অধ্যাপক পাই খাইইউয়ান দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে যে গবেষণা করেছেন, তার লেখা অনুবাদ করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন তারই আলোকে এ বইটি লেখা। বলা যায় পাই খাই ইউয়ানের দীর্ঘ চার দশকের কাজের প্রতিফলনও এই মূল্যবান বইটি।
এখানে আমি অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ানের বিষয়ে বাংলাদেশের পাঠকদের সংক্ষেপে কিছু তথ্য জানাতে চাই।
অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান চীনের প্রবীণ লেখক, পণ্ডিত, গবেষক এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি রবীন্দ্র রচনাবলী, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাসহ বাংলা সাহিত্যের অনেক সম্পদ চীনা ভাষীদের কাছে তুলে ধরেছেন অনুবাদ ও নিজস্ব লেখার মাধ্যমে। চীনের মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবের(১৯৪৯ সাল) মাত্র চার বছর আগে ১৯৪৫ সালে জিয়াং সু প্রদেশের চাং চৌ শহরে পাই খাই ইউয়ানের জন্ম। ১৯৬৫ সালে বিশ বছরের তরুণ পাই প্রথম পা রাখেন বাংলাদেশে। তখন এই ভূখণ্ডের পরিচিতি ছিল পূর্ব পাকিস্তান নামে। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা ভাষা শেখেন বাংলা একাডেমিতে। তখনই তিনি বিশ্বের মধুরতম ভাষাটির প্রেমে পড়েন আকণ্ঠ এবং পাশাপাশি ভালোবেসে ফেলেন পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি।
চীন ও বাংলাদেশ। দুই দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির যোগসূত্র স্থাপনে যে মুষ্ঠিমেয় গুণী মানুষরা কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম অগ্রগণ্য পাই খাই ইউয়ান।
১৯৬৯ সালে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের (সেসময় রেডিও পিকিং) বাংলা বিভাগে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক পাই সাহেব ১৯৮৫ সালে ঢাকায় আসেন দ্বিতীয় সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। দ্বিতীয় সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ শিরোনামে ম্যাস জিমনাস্টিকস প্রদর্শনে বাংলাদেশের ক্রীড়া বিভাগকে যে চীনা কোচদল সাহায্য করে, সেই দলের অনুবাদক ছিলেন তিনি।
পাই সাহেব আবার বাংলাদেশে আসেন নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯১-৯২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেন।
দীর্ঘ ৩৬ বছর চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগে সাংবাদিকতা করার পর ২০০৬ সালে অবসর নেন পাই খাই ইউয়ান। কিন্তু নিয়মিত চাকরি শেষ হলেও কাজ তাঁকে ছাড়েনি। তিনি বাংলা বিভাগে বিশেষ কর্মী হিসেবে কাজ চালিয়ে যান।
২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চীনের কুনমিং শহরে ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকও তিনি। বর্তমানে তিনি চীনের ন্যাশনাল ট্রান্সলেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং চীনের ভারতীয় সাহিত্য গবেষণা অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা সমগ্রের চীনা অনুবাদ গ্রন্থের অন্যতম প্রধান সম্পাদক। বাংলা ভাষা থেকে অনুদিত সমস্ত কবিতা সম্পাদনা করা তাঁর দায়িত্ব।
এবার আসি তাঁর অনুবাদ কর্মের প্রসঙ্গে। চীনে রবীন্দ্র রচনাবলীর অন্যতম প্রধান অনুবাদক ও সম্পাদক তিনি। ‘শান্তিনিকেতনের প্রাণের সুর’ নামে তাঁর অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথের তিনশ’ কবিতার সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় চীনের কুয়াংসি প্রদেশের গণ প্রকাশনালয় থেকে। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত হয় পাই অনুদিত রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনমূলক কবিতা সংকলন। এখানে কণিকা, লেখন ও স্ফুলিংগ বইয়ের কবিতাগুলো সংকলিত হয়। তাঁর অনুদিত পুনশ্চ, শেষ সপ্তক, পত্রপুট ও শ্যামলী বইয়ের কবিতাগুলো নিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতা সংকলন’ প্রকাশিত হয়েছে চেজিয়াং প্রদেশের সাহিত্য প্রকাশনালয় থেকে। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের অনুবাদ প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গীতি কবিতা সংকলন।
চীনের কুয়াংতং প্রদেশের সাহিত্য প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত ‘বিশ্ব কাব্যভাণ্ডার’ নামের বিশাল গ্রন্থে স্থান পেয়েছে পাই খাই ইউয়ান অনুদিত মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কপোতাক্ষ নদ’, ‘পুরুরবার প্রতি ঊর্বশী’, বিষ্ণু দে’র ‘মহাশ্বেতা’, ‘ভারতীয় বিমানবাহিনী’, ‘বেনুর জন্য’ ‘ছত্তিশগড়ীর গান, ‘২২শে শ্রাবণ’ বুদ্ধদেব বসু’র অসূর্যস্পর্শ্যা, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ ‘কোনো কুকুরের প্রতি’ ‘স্মৃতির প্রতি’ ‘ভিনদেশী’, ‘বেশ্যার মৃত্যু’ জীবনানন্দ দাশের ‘নগ্ন নির্জন হাত’‘রাত্রিদিন’, ‘অদ্ভুত আঁধার এক, ‘ভোর’, ‘ছটি বোমার ১৯৪২’, ‘তোমাকে ভালোবেসে’, জসীম উদদীনের ‘কবর’, শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা’, ‘প্রলয়ান্তে’ ‘আভাস’, সৈয়দ আলি আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’, ‘সিন্ধু মরুভূমির মধ্যে’।
পাই খাই ইউয়ান আরও বেশ কিছু বই চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা সংকলন প্রকাশ হয়েছে চীনের কুয়াংসি প্রদেশের লিজিয়াং প্রকাশনালয় থেকে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস নৌকাডুবি চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। চীনের আনহুই প্রদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সনেট সংকলন। রবীন্দ্রনাথের শিশু ও শিশু ভোলানাথ বইদুটি প্রকাশ হয়েছে আনহুই থেকে। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সংকলন গঙ্গা নদীর তপোবন নামে প্রকাশ করেছে চীন বেতার ও টিভি প্রকাশনালয়। রবীন্দ্রনাথের য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, যাভাযাত্রীর পত্র, রাশিয়ার চিঠি এবং টকস ইন চায়নার অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকাহিনী সংকলন হিসেবে প্রকাশিত। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কাহিনী কবিতার বই ‘কথা কাহিনী’ প্রকাশ হয়েছে সাংহাই থেকে। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, সোনারতরী, নদী, চিত্রা, কণিকা, লেখন, কাহিনী, কল্পনা, স্মরণ, শিশু, গীতালী, বলাকা, পলাতকা, শিশু ভোলানাথ, পুরবী, বনবাণী, পরিশেষ, পুনশ্চ, বিচিত্রা, শেষ সপ্তক, পত্রপুট, শ্যামলী, খাপছাড়া, ছড়ার ছবি, প্রান্তিক, সেঁজুতি, প্রহাসিনী, আকাশপ্রদীপ, নবজাতক, সানাই, রোগশয্যা, আরোগ্য, জন্মদিনে, ছড়া, শেষলেখা, সহজপাঠ, স্ফুলিংগ অনুবাদ করেছেন এবং এগুলো হ্যপেই প্রদেশের শিক্ষা প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অন্য দুজন অনুবাদকের সঙ্গে যুক্তভাবে অনুবাদ করেছেন সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, মানসী, চৈতালী, নৈবেদ্য, কেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, মহুয়া, বীথিকা ও কবিকাহিনী।
চীন আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশ হয়েছে তাঁর অনুদিত রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণমূলক বই জীবন স্মৃতি, আমার ছেলেবেলা ও ছিন্নপত্র। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস যোগাযোগ অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছে কুয়াংসি প্রদেশের লিজিয়াং প্রকাশনালয়। চীনের যুব প্রকাশনালয় প্রকাশ করেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সংকলন ও গল্প সংকলন। চীনের বাণিজ্য প্রকাশনালয় প্রকাশ করেছে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ ‘জীবন প্রসংগে’, ‘শিক্ষা প্রসংগে’, ‘সাহিত্য প্রসংগে’।
রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি ইংরেজি বইয়েরও অনুবাদ করেছেন তিনি।
চীন আন্তর্জাতিক বেতারের প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা সংকলন। দুই খন্ডে প্রকাশিত ১০৯৭ পৃষ্ঠার এই বইতে অনুদিত হয়েছে নজরুলের ৪১৯টি কবিতা ও ১৫২টি গান। বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক দিলারা হাশেমের উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ অনুবাদ করেছেন তিনি।
অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান বয়সের দিক থেকে এখন বৃদ্ধ। কিন্তু কোন কোন মানুষ আছেন যারা কর্ম ক্ষমতা ও প্রাণ চাঞ্চল্যের দিক থেকে চির তরুণ। আমাদের প্রিয় পাইভাই তেমনি একজন তরুণ। তিনি এখনও বাংলা সাহিত্যকে চীনাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার গুরু দায়িত্ব পালন করে চলেছেন আনন্দের সঙ্গে।
চীনাভাষায় রবীন্দ্রজীবনী প্রকাশ অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ানের জীবনব্যাপী সাধনার ফসল বললেও অত্যুক্তি হয় না। এই রবীন্দ্র জীবনীর মাধ্যমে চীনের নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে নতুনভাবে বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
এ বছর রবীন্দ্রনাথের চীন সফরের শতবর্ষ পালন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সেমিনার সিম্পোজিয়াম হচ্ছে সেখানে এই বইটি নিয়েও আলোচনা চলছে। বাংলাভাষা ও চীনাভাষার মতো দুটি সাহিত্য-সমৃদ্ধ ভাষার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে চিরন্তন সেতু রচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘিরে।