সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ ও ‘সোভিয়েত নারী’ নামক মাসিক পত্রিকা দুইটির গ্রাহক ছিলাম আমরা। ডাক বাহক প্রতিমাসে পত্রিকা দুইটা দিয়ে যেতেন। কোনও মাসে পত্রিকা আসতে দেরি হলে আমরা অস্থির হয়ে উঠতাম।
Published : 07 Dec 2020, 07:28 AM
একবার মনে আছে এক মাসের পত্রিকা এলো না। কিন্তু পরের মাসে দুটো পত্রিকা একসাথে পেয়েছিলাম। যে মাসে পত্রিকা আসেনি, সেই মাসে ডাক বাহক জিল্লুর চাচাকে আমারা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ছেড়েছিলাম। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন আমাদের পত্রিকা মার যাবে না, আসলে তিনি অবশ্যই পৌঁছে দেবেন। জিল্লুর চাচা খুব সৎ ও ভালো মানুষ ছিলেন, আমাদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার করতেন।
আমার এই পত্রিকা পড়ার চেয়ে বেশি আকর্ষণ ছিল ছবিগুলো দেখায়। এর অর্থ এই না যে আমি পত্রিকাগুলো পড়তাম না। যদিও তখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিলাম তবুও আমাকে সেটা পড়তে হত। কিছু কিছু জিনিস নিজ আগ্রহে পড়তাম। এখনও মনে আছে ‘পেদিয়া’ ও ‘ফেদিয়া’ নামক দুই জমজ বোনের কাহিনী পড়েছিলাম। এই দুই বোনকে অস্ত্রোপচার করে একজনের শরীর থেকে আরেকজনকে আলাদা করেছিল চিকিৎসকরা।
পত্রিকার রঙিন ছবিগুলো বাস্তবিক আমার মন কেড়ে নিত। বিশেষ করে শরৎকালীন প্রকৃতির ছবিগুলো আমাকে পাগল করে তুলতো। সেখানে দেখতাম গাছের রঙিন পাতা। তখন মনে হত এই গাছগুলোর পাতা বোধহয় আগাগোড়া এরকম রঙিনই। তখন ঠিক বুঝতাম না, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গাছের পাতাগুলোর রং পরিবর্তিত হওয়ার পর ঝরে পড়ে।
যা হোক, সে সময়ের ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ ও ‘সোভিয়েত নারী’ পড়ে এবং ছবি দেখে এতটাই মুগ্ধ ও রোমাঞ্চিত হতাম যা ভাষায় প্রকাশ করার না। তখন থেকেই ইউরোপের প্রকৃতি দেখার ও ছবি তোলার অদম্য আগ্রহ ছিল মনে। ১৯৯৩ সালের ২৬ এপ্রিল দেশ ছাড়লাম পড়ন্ত বিকালে। পরদিন ভোরে মস্কো পৌঁছলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাসে উঠে বড় রকমের একটা ধাক্কা খেলাম। সেটা প্রকৃতির রূপে নয়, বাসের যাত্রীদের মুখ দিয়ে ভদকা আর পিভার (বিয়ার) গন্ধে।
একজনকে সিগারেটও টানতে দেখলাম। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিলাম তার উপর এসব অপরিচিত দুর্গন্ধে আমার প্রচণ্ড বমির উদ্রেক হচ্ছিল। দুই শ কিলোমিটার বেগের ঝড়ও বোধহয় এরকম প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা দিতে পারতো না। কোনমতে নিজেকে সামলে নিলাম। তখনো কিছুটা অন্ধকার ছিল। যখন সকাল হল তখনো প্রকৃতির রূপ সেরকম উপভোগ করা গেল না। কারণ আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সব কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগছিল। কেবলমাত্র উজ্জ্বল সূর্য কিরণের দেশ মাতৃভূমি ছেড়েছি। বাস থেকে নামার পর যখন একটু আলোর ভাব হল, তখন আমরা পাতাল পুরীর গহ্বরে নেমে গেলাম মেট্রোতে চড়তে।
পাতাল রেল থেকে বেরিয়ে হতাশ হলাম রঙিন পাতার কোনও গাছ চোখে পড়লো না। মোটকথা অল্পকিছু সবুজ পাতার গাছ ছাড়া বাকি সব নাড়া খাড়া পাতা-বিহীন। কিছু গাছ কেবল মাত্র কুশি ছাড়া শুরু করেছে। সেই গ্রীষ্মেই মস্কো ছেড়ে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে গেলাম। সেখানেও শরতে প্রকৃতির রূপ তেমন উপভোগ করার সুযোগ হয়নি। বেশ ঝামেলার মধ্যে ছিলাম। তাছাড়া বড় কোন শহরে গাছ পালার চেয়ে দালান কোঠায় বেশী থাকে। বিশেষ করে জার্মানির মত এত বন, গাছ-পালা ইউরোপের অন্যদেশে কম। জার্মানির প্রথম শরৎকালে প্রকৃতির রূপ মন ভরে উপভোগ করেছিলাম। তখন আমি ছিলাম বুজবুর্গ শহরে। শহরটার কেন্দ্র সমতল হলেও আশেপাশে শুধু পাহাড়ি এলাকা। গাছপালা পার্ক আর বনভূমিতে ভরপুর। অপরূপ এক সৌন্দর্যের শহর সব কিছু ছবির মত। যেন শিল্পী তার ক্যানভাসে এঁকেছে পুরো শহরটাকে। শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে চমৎকার এক নদী। নদীর দু’পাড়ে গাছ-পালার অপরূপ সমারোহ।
পাহাড়ের পর পাহাড় সেখানে আঙ্গুর বাগান। আমরা শহরের কেন্দ্র থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে একটা প্রাক্তন সেনানিবাসে থাকতাম। ওই সেনানিবাসের আশে পাশের দৃশ্য ছিল অপরূপ। সোভিয়েত পত্রিকায় যে ছবি দেখেছিলাম সে সকল দৃশ্য রাশিয়াতে না দেখতে পেয়ে আশাহত হয়েছিলাম। কিন্তু তা পূর্ণ হয়েছিল জার্মানির বুজবুর্গে।
গত কয়েকদিন আগে কাজ থেকে ফেরার সময় সাইকেলে পড়ন্ত বেলায় প্রকৃতির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল প্রকৃতি আমার প্রিয়ার মত কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, “তুমি কি এত ব্যস্ত আমার দিকে তাকানোর মতো কোন সময়ই নেই? ফিরে দেখার ইচ্ছা নেই? আর কয়েকদিন পরে শীতে আমার মৃত্যু হবে, আর আমাকে পাবেনা। তোমার কি আমার স্মৃতি ধরে রাখার কোন ইচ্ছাই নেই?” এই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারিনি। পরদিন সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে তিন চার ঘণ্টা ছবি তুললাম প্রকৃতির।
শরতের শুরুটা ইউরোপে রঙের বাহারে ভরপুর। বৈশাখী মেলায় বাঙালি নারীরা যেমন হাজারো রঙে রাঙিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করে, তেমন এখানে প্রকৃতি রঙের খেলায় মেতে উঠে। তবে এখানে শরতেই যে ঠাণ্ডা পড়ে তা আমাদের দেশের কড়া শীতকেও হার মানায়। আমাকে এদিন ছবি তোলার সময় হাতমোজা ব্যবহার করতে হয়েছিল, যা ছবি তোলার ক্ষেত্রে খুব স্বস্তিকর না। এ সময় পাখির আনাগোনা কমে যায়। ভ্রমণপ্রিয় পাখিরা যেদিকে গরম সেদিকে উড়তে থাকে। কিন্তু কিছু পাখি অত্যন্ত জাতীয়তাবাদী, তারা মাতৃভূমি ছেড়ে কোথাও নড়ে না। এমনকি মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেও না। সেই ঠাণ্ডার মধ্যেও কিচিরমিচির করতে দেখেছি। এসময় পাখির আনাগোনা কমে গেলেও বনের আশেপাশের এলাকায় হরিণের উপস্থিতি বেড়ে যায়। সেও এক অপরূপ সৌন্দর্য কোন কোন সময় দু/তিন বাচ্চাসহ হরিণ চোখে পড়ে।
শরতের আর একটা পরিচিত চিত্র বাড়ির সামনে অনেককেই ঝাঁটা-বাড়ুন নিয়ে ঝাড় দিতে দেখা যাবে। প্রচুর পাতা পড়ে এই সময় গাছ থেকে যা পঁচিয়ে সবুজ সার তৈরি করে জার্মানরা। এবারে শরৎকালে মাঝেমাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। যার কারণে শরতের একটা পরিচিত রূপ উপভোগ করা যাচ্ছে না। তা’হল এ সময়ে অসংখ্য পাতা পড়ে থাকে বনের মধ্য, রাস্তা-ঘাটে। বৃষ্টি না হলে শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটলে যে শব্দ হয় তা এক মজার অনুভূতি। কিন্তু এ বছর সে মজার অনুভূতির পরিবর্তে ভেজা পাতার উপর সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। যাতে পা পিছলে না পড়তে হয়। এই পরিস্থিতিতে সাইকেল চালানোর সময়ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ভেজা পাতার উপর সাইকেলে মোড় নিতে গেলে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |