ত্রিপুরার রাজ পুরোহিত রঘুপতি দুই হাতে তুলে নিলেন বিশাল দেবী প্রতিমাকে। তারপর দীর্ঘদেহী সবল রঘুপতি সেই প্রতিমা বিসর্জন দিলেন নিজের হৃদয় থেকে। রঘুপতির উদাত্ত কণ্ঠে মুগ্ধ দর্শক। মঞ্চের উইংসের পাশ থেকে সভয়ে তাকিয়ে আছেন ইন্দিরা দেবী। রঘুপতি যেভাবে ভারী মূর্তিটা তুলে ছুড়ে ফেললেন তাতে সেটা আরেকটু হলেই তার গায়ে পড়ত। তবে ইন্দিরা দেবী জানেন, অভিনয়ের সময় চরিত্রের মধ্যে ডুবে যান রবিকাকা।
Published : 08 May 2014, 12:06 AM
রবীন্দ্রনাথের অভিনয় প্রতিভা ছিল অসাধারণ। ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব নাটকের প্রায় সবগুলোতেই তিনি অভিনয় করেছেন।
নিজের লেখা ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’, ‘বিসর্জন’, ‘রাজা-রানী’, ‘চিরকুমার সভা’য় যেমন অভিনয় করেছেন তেমনি অভিনয় করেছেন স্বর্ণকুমারী দেবী ও দ্বিজেন্দ্রনাথের লেখা নাটকেও। সে সময় চলচ্চিত্র থাকলে হয়ত চলচ্চিত্রেও অভিনয় করতেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ নিজে চলচ্চিত্রে অভিনয় না করলেও ১৯৩২ সালে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। রবীন্দ্রনাথ তার লেখা কাহিনিকবিতা ‘পূজারিণী’কে ‘নটীর পূজা’ নাম দিয়ে প্রথমে মঞ্চে নৃত্যনাট্য হিসেবে উপস্থাপন করেন। গৌতম বুদ্ধের পূজারিণী শ্রীমতি ধর্মের জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হয় না। ভয় পায় না রাজশাসনের রক্তচক্ষুকে। নৃত্যশিল্পীর জন্য নাচও যে পূজারই নামান্তর সূক্ষ্ণভাবে একথা তুলে ধরতে রবীন্দ্রনাথ মঞ্চে আনলেন ‘নটীর পূজা’। পরবর্তীতে এই মঞ্চনাটকটিকেই চলচ্চিত্রে রূপায়িত করেন রবীন্দ্রনাথ। এতে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশনায় মঞ্চনাটকটির দৃশ্য ধারণ করা হয়।
১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস অবলম্বনে নরেশ মিত্রের পরিচালনায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই সিনেমায় নজরুল বেশ কটি রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করেন। বিশ্বভারতীর তরফ থেকে আপত্তি করা হয় যে গানগুলো যথাযথভাবে গাওয়া হয়নি। তখন নজরুল সোজা চলে যান রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে গান ব্যবহারের অনুমতিপত্র দিয়ে দেন এবং বিশ্বভারতীর এমন আচরণের সমালোচনাও করেন।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মিত তথ্যচিত্রটি সবচেয়ে বিখ্যাত।
রবীন্দ্রনাথের লেখা উপন্যাস, ছোটগল্প এমনকি কবিতা নিয়েও নির্মিত হয়েছে অসংখ্য টিভি নাটক, টেলিফিল্ম, চলচ্চিত্র। আর তার নাটকগুলো মঞ্চায়িত হয়েছে বহুবার।
ছোটগল্প ‘কাবুলিওয়ালা’ অবলম্বনে ১৯৬১ সালে বলিউডে বিমল রায়ের পরিচালনায় সিনেমা নির্মিত হয়। এতে কাবুলিওয়ালা রহমতের চরিত্রে বলরাজ সাহানির অভিনয় ব্যাপক প্রশংসিত হয়। ১৯৭১ সালে ছোটগল্প ‘সমাপ্তি’ অবলম্বনে নির্মিত ‘উপহার’ ছবি পরিচালনা করেন সুধেন্দু রায়।
অতিপ্রাকৃত গল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে ১৯৯১ সালে গুলজারের পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘লেকিন’। মূল গল্পে যদিও পটভূমি ছিল হায়দ্রাবাদ, গুলজার ছবিটি নির্মাণ করেন রাজস্থানে। মূল গল্পের অনেক অদলবদল করা হয়। ডিম্পল কাপাডিয়া, বিনোদ খান্না, আমজাদ খান অভিনীত সিনেমাটি ব্যবসা সফল হয়।
১৯৯৭ সালে ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘চার অধ্যায়’ নাম দিয়েই সিনেমা পরিচালনা করেন কুমার সাহানি। সিনেমাটি বাংলা ও হিন্দিতে নির্মিত হয়। অভিনয় করেন নন্দিনী ঘোষাল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় গল্প ‘দৃষ্টিদান’ অবলম্বনে মারাঠি ভাষায় ‘দৃষ্টিদান’ নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ অবলম্বনে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫৩ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার।
বাংলাদেশে ২০০৬ সালে কাজী হায়াতের পরিচালনায় ‘কাবুলিওয়ালা’ নির্মিত হয়। এতে অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত অভিনেতা মান্না। সিনেমাটি দর্শকপ্রিয়তা পায়।
চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘শাস্তি’ অবলম্বনে ২০০৫ সালে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘শাস্তি’। এতে অভিনয় করেন চম্পা, ইলিয়াস কাঞ্চন, পূর্ণিমা ও রিয়াজ।
২০০৬ সালে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালনা করেন চলচ্চিত্র ‘সুভা’। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে পূর্ণিমা অভিনয় করেন।
১৯৬০ সালে তপন সিনহা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সিনেমাটিতে মূল গল্প মোটামুটি অবিকৃত রাখা হয়।
‘ক্ষুধিত পাষাণ’ সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন অরুন্ধতী দেবী, ছবি বিশ্বাস ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সিনেমাটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল, ব্যবসা সফলও হয়েছিল। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন ‘তিনকন্যা’। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মণিহারা’ এবং ‘সমাপ্তি’ নিয়ে তিনটি পৃথক কাহিনিচিত্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ‘তিনকন্যা’। পোস্টমাস্টারের রতন, মণিহারার মণিমালিকা এবং সমাপ্তির মৃন্ময়ী। তিন নারীকে নতুনভাবে নির্মাণ করেছেন সত্যজিৎ রায়।
বড় গল্প নষ্টনীড় অবলম্বনে ১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘চারুলতা’ মুক্তি পায়। চারুর ভূমিকায় মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং অমলের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনবদ্য অভিনয় করেন।
পরবর্তীতে রীমা মুখার্জি ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনা করেন।
রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেটা’ কবিতা অবলম্বনে সন্তোষ ঘোষালের পরিচালনায় নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘ছেলেটা’।
২০০৩ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘চোখের বালি’। রবীন্দ্রনাথের এই উপন্যাসটি কিছুটা ভিন্ন ব্যাখ্যা ও ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত হয় এখানে। মহেন্দ্রর ভূমিকায় প্রসেনজিৎ, বেহারির চরিত্রে টোটা রায়চৌধুরী, আশালতার ভূমিকায় রাইমা সেন এবং বিনোদিনীর ভূমিকায় ঐশ্বরিয়া রাই অভিনয় করেন।
সিনেমাটি বাংলা ভাষায় নির্মিত সিনেমা হিসেবে সেরা চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার পায়। লকার্নো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা সিনেমার গোল্ডেন লেপার্ড জয় করে। ভারতের আন্তর্জাতিক উৎসবসহ প্রায় ২৫টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিত হয় এবং সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। বক্স অফিসেও সফল হয় সিনেমাটি। বিশেষ করে বিনোদিনী চরিত্রে ঐশ্বরিয়া এবং মহেন্দ্র চরিত্রে প্রসেনজিত শুধু অনবদ্য অভিনয়ই করেননি এই ভূমিকাদুটিতে তাদের বিকল্প সে সময় আর কেউ ছিলেন না। বাংলা ভাষায় নির্মিত সিনেমাটি পরবর্তিতে হিন্দিতে ডাবিং করা হয়।
রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ২০০৮ সালে চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়।
২০১২ সালে ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস অবলম্বনে বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের পরিচালনায় পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত হয় ‘এলার চার অধ্যায়’ স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা কাহিনিতে এলার ভূমিকায় অভিনয় করেন পাওলি দাম।
রবীন্দ্রনাথের বহুলপঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’। বাংলাদেশ টেলিভিশনে শেষের কবিতার প্রথম চিত্রায়ণে লাবণ্য চরিত্রে কবি সুরাইয়া খানম এবং অমিত চরিত্রে সৈয়দ আহসান আলী সিডনি অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীতে শেষের কবিতা নিয়ে দুই বাংলায় রেডিওতে কণ্ঠনাটক এবং টিভিতে নাটক ও টেলিফিল্ম হয়েছে। ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় শেষের কবিতা চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মিত হয়। এর ইংরেজি নাম দেওয়া হয় ‘দ্য লাস্ট পোয়েম’। এতে লাবণ্য চরিত্রে কঙ্কনা সেনশর্মা এবং অমিত চরিত্রে রাহুল বোস অভিনয় করেছেন।
বাংলাদেশ ও ভারতে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলো অসংখ্যবার মঞ্চায়িত হয়েছে। ‘রক্তকরবী’, ‘ডাকঘর’, ‘বিসর্জন’, ‘শ্যামা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘বাল্মিকীপ্রতিভা’, ‘মুক্তধারা’, ‘অচলায়তন’সহ বিভিন্ন নাটক বিভিন্ন নাট্যদল মঞ্চায়ন করেছে। ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ এবং ‘বিদায় অভিশাপ’-- এই তিনটি কাহিনিকবিতাকে একসঙ্গে অথবা পৃথকভাবে মঞ্চে আনা হয়েছে। ঢাকার মঞ্চে পঞ্চাশের দশকে ড্রামা সার্কেল প্রথম রক্তকরবী নাটক মঞ্চায়ন করে।
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো নাটক ঢাকার মঞ্চে এনেছে। এর মধ্যে ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’ ও ‘রক্তকরবী’ উল্লেখযোগ্য। ‘দুইবোন’ ও ‘ঘরেবাইরে’ উপন্যাস দুটি নাট্যরূপ দিয়ে ফেরদৌসী মজুমদারের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে থিয়েটার। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘শাস্তি’ মঞ্চে আনে নান্দনিক। ঢাকা লিটল থিয়েটার রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ গল্পকে শিশুকিশোরদের উপযোগী করে মঞ্চে আনে আশির দশকে। শিশুকিশোরদের জন্য নাট্যরূপ দিয়েছিলেন প্রয়াত সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ নাজমা জেসমিন চৌধুরী।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের কিছু ঘটনা নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ মঞ্চনাটকের মূল চরিত্র রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা নিয়ে সংঘমিত্রা চৌধুরীর পরিচালনায় একটি ব্যতিক্রমী সিনেমা হল ‘বিদেহীর খোঁজে রবীন্দ্রনাথ’।
বিটিভিসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্প ও উপন্যাস চিত্রায়িত হয়েছে। এখনও হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসগুলোর কোনোটার প্রেক্ষাপট ব্রিটিশ ভারত আবার কোনোটার হয়ত আরও সুদূর অতীত। কিন্তু এগুলো দর্শকপ্রিয়তা পায় বরাবরই। কারণ প্রেক্ষাপট অতীত হলেও মানুষের মনোলোকের অন্তর্দ্বন্দ্ব, টানাপড়েন, দুঃখ যন্ত্রণা আনন্দ-বেদনার অনুভূতি চিরকালীন। এই শ্বাশতের রূপকার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি তাই চির-প্রাসঙ্গিক।