বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১২ বৈশাখ প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ‘আব্দুল জব্বারের বলী খেলা’। এবছর মেলার ১১৫তম আসর।
Published : 23 Apr 2024, 09:07 PM
গৃহস্থালী আর ঘর সাজানোর পণ্য নিতে যে মেলার জন্য চট্টগ্রামের মানুষ অপেক্ষায় থাকেন সেই ঐতিহাসিক ‘আব্দুল জব্বারের বলী খেলা’কে কেন্দ্র করে বৈশাখী মেলা শুরু হচ্ছে বুধবার।
বলী খেলা উপলক্ষ্যে লালদীঘি মাঠ ঘিরে তিনদিনব্যাপী বৈশাখী মেলা শুরু হতে একদিন বাকী থাকলেও এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দোকানিরা আসতে শুরু করেছেন; পসরা সাজিয়ে বসে গেছেন বেচাবিক্রিতে।
বুধবার থেকে মেলা শুরু হলেও মূল আকর্ষণ ঐতিহাসিক বলী খেলা অনুষ্ঠিত হবে বৃহস্পতিবার বিকালে লালদীঘি মাঠে।
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১২ বৈশাখ চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘি মাঠে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় এই ঐতিহাসিক ‘আব্দুল জব্বারের বলী খেলা’। এ বছর অনুষ্ঠিত হবে বলী খেলার ১১৫তম আসর।
বলী খেলাকে কেন্দ্র করে কোতোয়ালী থানা মোড় থেকে জেল রোড, লালদীঘি হয়ে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল ও সিনেমা প্যালেস মোড় পর্যন্ত মাঠের আশপাশের প্রায় দেড় বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বসে মেলা।
মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, ফুলদানি, পুতুল, বেত-কাঠ ও বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, হাতপাখা, মাছ ধরার পলো, বেতের তৈরি ডালা, কুলো, ফলদ, বনজসহ ফুল গাছের চারা, মুড়ি মুড়কি, পাটি, মাদুর, চুরি, কসমেটিকস, দা-বটি, ছুরিসহ এহেন কোনো পণ্য নেই, যা পাওয়া যায় না এ মেলায়। মেলাকে নিয়ে শিশুদেরও আনন্দের কমতি থাকে না।
মেলা কমিটির আহ্বায়ক ও ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও মালামাল নিয়ে এখানে বিক্রেতারা আসেন।
অন্তত দুই হাজার বিক্রেতা মেলায় এসেছেন বলে ধারণা তার।
এবারের মেলায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানান জহরলাল হাজারী।
“এ বছর থেকে সিটি করপোরেশন পাবলিক লাইব্রেরির সামনের অংশে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। উদ্যোক্তারা নিজেদের তৈরি পণ্য নিয়ে আসলে এখানে বসার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।”
মঙ্গলবার বিকালে লালদীঘি ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মাঠে চলছে বলী খেলার মূল মঞ্চের সাজসজ্জার কাজ। আর লালদীঘি মাঠ সংলগ্ন রাস্তা থেকে শুরু করে সিনেমা প্যালেস, কেসি দে রোডসহ বিভিন্ন স্থানে দোকানিরা তাদের দোকানের মালামাল সাজাতে ব্যস্ত।
ঢাকার জুরাইন থেকে মেলায় কাঠের আসবাবপত্র নিয়ে এসেছেন ওয়াসিম মুন্সী। সিনেমা প্যালেস মোড়ের ট্রাফিক বক্সের সামনে সড়কে পসারা সাজিয়ে বসেছেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মেলায় এসব ফার্নিচারের চাহিদা অনেক বেশি। কম দামের মধ্যে লোকজন তাদের ঘরের জন্য চাহিদার ফার্নিচার ক্রয় করতে পারেন।
“২৫ বছর ধরে এ বলী খেলার মেলায় আসছি। প্রতিবছর যা নিয়ে আসি সব বিক্রি করে ফিরে যাই। এবছর খাট, আলমারিসহ ৫৫টি জিনিস এনেছি, যার মধ্যে খাট বেশি। কালকে (বুধবার) মেলা শুরু হলেও আমরা এসেছি শনিবার। কিছু কিছু বিক্রি হচ্ছে।”
একই জায়গায় বসেছেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার বাকিলা থেকে আসা জাকির হোসেন।
মঙ্গলবার বিকালে মেলায় আনা ফার্নিচারে রঙ-বার্নিশ করতে ব্যস্ত ছিলেন জাকির।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বলেন, “অন্তত ২০ বছর ধরে এ মেলায় আসছি আমরা। গত রোববার ৮০টি ফার্নিচার নিয়ে আসছি। আশা করছি সবগুলোই বিক্রি করতে পারব।”
নবাবগঞ্জের দোহার থেকে থেকে টব, শো-পিসসহ মাটির নানা জিনিস নিয়ে এসেছেন পরান পাল। সিনেমা প্যালেসের পাশে সড়কে পসরা সাজিয়ে বসেছেন তিনি।
তিনি জানান, দোহারে ‘মা-মৃৎ শিল্প’ নামে একটি দোকান আছে। কিন্তু প্রতিবছর চট্টগ্রামে এ মেলায় আসেন। এবারও আগে চলে এসেছেন।
পরান পাল বলেন, “আমাদের হিসাবে চট্টগ্রামের আব্দুল জব্বারের বলী খেলার মেলাটি শেষ মেলা। সামনে বর্ষা চলে আসবে। আর কোনো বড় মেলা হবে না কোথাও। শীতের মৌসুমে গিয়ে আবার মেলা শুরু হবে। তাই এ মেলাটির দিকে বিক্রেতাদের অনেক আগ্রহ থাকে।”
তবে মেলায় বেচাবিক্রির আশার পাশাপাশি হাতাশাও আছে তার।
পরান পাল বলেন, এ মেলায় ক্রেতার চাহিদার চেয়েও মাটির জিনিসের বিক্রেতা বেশি আসে। যার কারণে কেউই তেমন লাভ করতে পারেন না। অল্প লাভে বা গায়ের দামে মালামাল বিক্রি করে দিতে হয়। মাটির মালামালগুলো বেশি টানাটানি করা যায় না। যেগুলো নিয়ে আসি কম দামে হলেও সেগুলো বিক্রি করে ফেলতে হয়।
এ মেলায় চট্টগ্রামবাসীর সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ফুলের ঝাড়ু, বেতের গৃহস্থালীসহ নানা সরঞ্জামের দিকে।
গৃহস্থালী এসব জিনিসের জন্য মানুষ অপেক্ষায় থাকে মেলার জন্য। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে মেলা বন্ধ থাকায় গৃহস্থালী পণ্য নিতে না পারার আফসোসও দেখা গিয়েছিল অনেকের মনে।
হাজারি গলি ও লালদীঘি সোনালী ব্যাংকের মাঝামাঝি স্থানে বেতের তৈরি কুলা, চালুনি, মাছ ধরার পলোসহ বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন মো. হানিফ।
নরসিংদীর বেলাবো উপজেলা থেকে আসা হানিফ বলেন, বেলাবো বাজারে এসব বিক্রি হয়। বলী খেলার মেলার জন্য প্রতিবছর এগুলো সংগ্রহ করে এখানে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন।
লালদীঘি পার্ক এবং সিটি করপোরেশন পাবলিক লাইব্রেরির কোনায় বেতের তৈরি আসবাবপত্র নিয়ে বসেছেন সিলেট থেকে আসা রিপন আহমেদ। সোমবার সকালে তারা চট্টগ্রামে এসেছেন সিলেট থেকে।
তিনি জানান, শাহজালাল মাজার গেইটে তাদের দোকান আছে। কিন্তু চট্টগ্রামের বলী খেলার মেলায় প্রতিবছর তারা আসছেন বংশ পরম্পরায়।
কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ থেকে পাটের রশির তৈরি দোলনা, ঘর সাজানোর পণ্য এবং হাতপাখা নিয়ে এসেছেন সাদ্দাম হোসেন।
তিনি জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে তারা বলী খেলার বৈশাখী মেলায় দোকান বসান। যার জন্য আগে থেকেই তারা প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তারা আগে থেকেই অর্ডার করে রাখেন এসব পণ্য তৈরির জন্য। আবার নিজেরাও তৈরি করেন।
বলী খেলার মেলায় চট্টগ্রামের মানুষের বেশি চাহিদা থাকে ফুল ঝাড়ুর। এমন কোন পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা বলী খেলার মেলা থেকে এ ফুল ঝাড়ু সংগ্রহ করেন না।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়াসহ নানা জায়গা থেকে এসব ফুল ঝাড়ু নিয়ে মেলায় আসেন দোকানিরা।
সিটি করপোরেশন পাবলিক লাইব্রেরির বিপরীতে লালদীঘি মাঠের সীমানা প্রাচীরের সাথে ফুটপাতে দোকান নিয়ে বসেছেন আব্দুল আলীম নামে এক ব্যক্তি।
বাঁশখালীর ইলশা ইউনিয়ন থেকে আসা আলীম বলেন, “বাপ-দাদারাও প্রতিবছর মেলায় আসতেন, এখন আমরা আসি। সারাবছর বিভিন্ন দোকানে ঝাড়ু সরবরাহ করেন তারা। সারাবছর যে পরিমাণ সরবরাহ করি তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয় বলী খেলার মেলায়।”
লালদীঘি মাঠ সড়ক বিভাজকের ওপর কাচের চুড়ি নিয়ে বসেছেন শাবানা নামের এক নারী।
তিনি জানালেন, ঢাকার চকবাজার থেকে প্রতিবছর তারা এখানে আসেন। তাদের এলাকার অনেকেই কাচের চুড়ি নিয়ে আসেন মেলায়।
ব্রিটিশ শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে ১৯০৯ সালে স্থানীয় আব্দুল জব্বার সওদাগর লালদীঘি মাঠে আয়োজন করেন কুস্তি প্রতিযোগিতা, যা পরবর্তীতে চট্টগ্রামবাসীসহ সারা দেশের মানুষের কাছে আব্দুল জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বলী খেলা ও মেলার জন্য সড়কে বন্ধ থাকবে যান চলাচল
প্রতিবছরের মতো এবছরও ২৪-২৬ এপ্রিল লালদীঘি মাঠের আশপাশের সড়কে যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
নগর পুলিশের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী বুধবার থেকে কোতোয়ালী, আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ মোড়, পুরাতন টেলিগ্রাফ অফিস, বোস ব্রাদার্স মোড়, রাইফেল ক্লাব, নবগ্রহবাড়ি মোড়, শাহ আমানত মাজার সড়কের মুখ ডাইভারশন দেয়া হবে। এসব সড়ক থেকে লালদীঘি মাঠমুখী সড়কে তিনদিন সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকবে।
এ তিনদিন আমদানি-রপ্তানি এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পণ্যবহনকারী ট্রাক-কভার্ড ভ্যানগুলো কতোয়ালী মোড় হয়ে ফিরিঙ্গিবাজার মেরিনার্স সড়ক দিয়ে চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জে প্রবেশ করবে।