দুই আসামির জবানবন্দিতে চট্টগ্রামে ব্যাংক কর্মকর্তা মেয়ে ও তার মা হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
Published : 25 May 2019, 08:29 PM
ওই দুই আসামি বলেছেন, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা (৬৭) ও তার ৯৪ বছর বয়সী মাকে মনোয়ারা বেগমকে হত্যার নির্দেশদাতা হলেন মনোয়ারারই ছোট ছেলে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মাসুদুর রহমান। এবং এটি ঘটেছে সম্পত্তি নিয়ে।
চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মেহেনাজ রহমানের আদালতে শনিবার মাসুদের নাম উল্লেখ করে জবানবন্দি দেন গ্রেপ্তার আসামি হারুনর রশিদ ওরফে মুন্না (৩৯) ও মো. মাহফুজ (২৮)।
হত্যা মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক ইলিয়াছ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুন্নাকে গ্রেপ্তারের পর আমরা নতুন করে মাসুদুর রহমানের নাম জানতে পেরেছি। তবে হত্যাকাণ্ডের সময় মাসুদ দেশে ছিলেন, নাকি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন, সে বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি।”
গত বছরের ১৫ জুলাই খুলশী থানার আমবাগান এলাকার মেহের মঞ্জিল নামে একটি ভবনের পানির ট্যাংক থেকে মেহেরুন্নেসা ও তার মায়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
অবিবাহিত মেহেরুন্নসা মাকে নিয়ে চট্টগ্রামের এই বাড়িটিতে থাকতেন।
মেহেরুন্নেসার নয় ভাই বোনের মধ্যে বড় দুই ভাই মারা গেছেন, একজন ঢাকায় ও একজন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। আর বোনদের মধ্যে বড় বোন ময়মনসিংহে, মেজ বোন সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে এবং অন্য দুজন যুক্তরাষ্ট্র ও আয়ারল্যান্ডে থাকেন।
এই হত্যাকাণ্ডের পর ডিবির তদন্তে মেহেরুন্নেসার এক ভাইপো মুশফিকুর রহমানের (৩২) নাম উঠে আসে, যিনি আগে ওই বাড়িতে থাকলেও নিজের পছন্দে বিয়ের পর আলাদা থাকছিলেন।
মুশফিক মনোয়ারার মেজ ছেলে মতিউর রহমানের সন্তান। ২০০৪ সালে মতিউর মারা যাওয়ার পর মুশফিকের মাকে বিয়ে করেন তার সেজ চাচা মোস্তাফিজুর রহমান।
মা-বোন হত্যার পর মোস্তাফিজই মামলা করেছিলেন; ওই মামলায় গ্রেপ্তার মুশফিক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, টাকা চেয়ে না পেয়ে তিনি একাই ফুপু ও দাদিকে হত্যা করেছিলেন।
তারপরও তদন্ত চালিয়ে যান ডিবি কর্মকর্তা ইলিয়াছ খান। ঘটনার সাত মাসের মাথায় জড়িত আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
নিহত মেহেরুন্নেসার খোয়া যাওয়া মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে গত ১২ মার্চ মো. মুসলিম (২৫) নামে এক রাজমিস্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যে মেহেরুন্নেসার প্রতিবেশী মো. মাসুদ রানা (৩৯) ও মো. শাহাবউদ্দিন ওরফে সাবু ওরফে মুছাকে (৩৭) গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর গত শুক্রবার বিকালে টাইগার পাস এলাকা থেকে মুশফিকের স্ত্রীর বড় ভাই মুন্না এবং মাহফুজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তদন্ত কর্মকর্তা ইলিয়াছ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডে স্বজন জড়িত থাকার কথা আমরা প্রথম থেকে বলে আসলেও মোট কতজন যুক্ত ছিল, তা নিয়ে ধোঁয়াশায় ছিলাম।
“মুসলিমকে গ্রেপ্তারের পর আমরা জেনেছিলাম, মুশফিকুর ও তার স্ত্রীর বড় ভাই মুন্নাসহ পাঁচজন জড়িত ছিল। তবে মুন্নাকে গ্রেপ্তারের পর আমরা তথ্য পেলাম হত্যাকাণ্ডে মোটআট জন জড়িত ছিল।”
এই আটজনের মধ্যে ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছেন, চারজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
ইলিয়াছ বলেন, “মুন্নাকে গ্রেপ্তারের পর আমরা জানতে পারি, স্বজনদের মধ্যে শুধু মুশফিক নয়, তার ছোট চাচা মাসুদুর রহমানও হত্যাকাণ্ডের দিন ওই বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। যাকে বাসায় দেখে অবাক হয়েছিলেন বোন মেহেরুন্নেসা।”
মুন্না জবানবন্দিতে বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের আগে মাসুদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এলেও মুশফিক ছাড়া পরিবারের অন্য কোনো সদস্য তা জানতেন না।
মুন্না বলেছেন, হত্যাকান্ডের আগের দিন ১৪ জুলাই শাহাবউদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে সেখানে মুশফিক, তার চাচা মাসুদ, মাসুদ রানা ও মুসলিমকে দেখকে পান তিনি। সেখানে বাড়ি বিক্রির দলিল তৈরি করে মেহেরুন্নেসাকে দাতা ও মাসুদ রানাকে গ্রহীতা করার কথা বলা হয়। কাজ হলে মেহেরুন্নেসার বাড়িটি তিন কোটি টাকায় শাহাবউদ্দিনের কিনে নেওয়ার কথা ছিল। তার অর্ধেক টাকা পাবে মুশফিক।
ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুন্না রাত দেড়টার দিকে মাহফুজ ও আসাদ নামে আরেকজনকে নিয়ে যায় মেহেরুন্নেসার বাড়িতে। যেখানে মুশফিক, মাসুদ, শাহাবউদ্দিন, মাসুদ রানা ও মুসলিম আগে থেকে অবস্থান করছিলেন বলে জানান মুন্না।
প্রথমে মাসুদ বাড়িতে ঢোকেন জানিয়ে মুন্না বলেন, তারপর অন্যরাও ঢোকেন। দলিলে স্বাক্ষর দেওয়া নিয়ে মেহেরুন্নেসার সঙ্গে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে মুশফিক তার তার ফুপুকে পিঁড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করেন।
“ওই সময় মুশফিক হাতে গ্লাভস দিয়ে মেহেরুন্নেসার গলা চিপে ধরে এবং মুসলিমকে কাপড় দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরতে বললে সে ধরে। মৃত্যু নিশ্চিত করে হাত, পা বাঁধা অবস্থায় লাশটি পানির ট্যাংকে ফেলে দেয়।”
জবানবন্দিতে মুন্না বলেছেন, মেহেরুন্নেসাকে হত্যার পর মাসুদের নির্দেশে মনোয়ারার কক্ষে ঢুকে তাকে বের করে নিয়ে আসেন। ওই সময় মনোয়ারা চিৎকার করলে শাহাবউদ্দিন তাকে লাথি মারেন। এতে দেয়ালের সাথে লেগে মনোয়ারা অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর মুসলিম গলা চেপে ধরে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করে মনোয়ারার লাশটিও পানির ট্যাংকে ফেলে দেয়।
মুন্না দাবি করেন, এরপর তারা ঘরের স্টিলের আলমারি ভেঙ্গে নগদ ২০ লাখ টাকা বের করেন। তখন মাসুদ কোরআন শরিফ এনে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রকাশ না করার শপথ করান তাদের। এরপর মাসুদ তাদের এক লাখ টাকা টাকা দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে চলে যায়।
তদন্ত কর্মকর্তা ইলিয়াছ বলেন, “হত্যাকাণ্ডের সময় মাসুদ দেশে ছিলেন, নাকি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন সে বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি।”
এদিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসাদকে খোঁজার পাশাপাশি গ্রেপ্তার শাহাবউদ্দিন ও মাসুদ রানাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবার রিমান্ডে চাইবেন বলে জানান তিনি।