চট্টগ্রামে মা-মেয়েকে হত্যার পর ‘একে অন্যদের বাঁচানোর শপথ’

চট্টগ্রামে গত বছর ব্যাংক কর্মকর্তা মেয়ে ও তার মাকে হত্যায় এক স্বজন গ্রেপ্তারের পর আদালতে ‘একাই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার কথা’ জানিয়ে জবানবন্দি দেওয়ার সাত মাস পর এ ঘটনায় জড়িত আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2019, 12:36 PM
Updated : 14 March 2019, 12:52 PM

তাদের একজনের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ইলিয়াছ খান বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডে নিহতদের ওই স্বজন মুশফিকুর রহমানসহ পাঁচজন জড়িত ছিলেন। হত্যার পর তারা ‘কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করেছিলেন যে, যদি কেউ গ্রেপ্তার হন তাহলে অন্য কারও নাম তিনি বলবেন না’।

গত বছরের ১৫ জুলাই খুলশী থানার আমবাগান এলাকার মেহের মঞ্জিল নামে একটি ভবনের পানির ট্যাংক থেকে সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা (৬৭) ও তার ৯৪ বছর বয়সী মা মনোয়ারা বেগমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এ ঘটনায় মনোয়ারার সেজ ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে খুলশী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। থানা ঘুরে এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় গোয়েন্দা পুলিশ।

এই ভবনে হত্যা করা হয়েছিল মেহেরুন্নেসা ও তার মাকে

গোয়েন্দা পুলিশ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়ে ২৩ জুলাই মেহেরুন্নেসার ভাইপো ও মনোয়ারার নাতি মুশফিকুর রহমানকে (৩২) গ্রেপ্তার করে।

মুশফিক মনোয়ারার মেজ ছেলে মতিউর রহমানের সন্তান। ২০০৪ সালে মতিউর মারা যাওয়ার পর মুশফিকের মাকে বিয়ে করেন তার সেজ চাচা মোস্তাফিজুর, যিনি মামলার বাদী।

মেহেরুন্নেসা ও মনোয়ারার কাছে বড় হওয়া মুশফিক তাদের অমতে বিয়ে করায় তাকে মেহের মঞ্জিল ছাড়তে হয়েছিল। এ নিয়ে দাদি-ফুপুর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি।

গ্রেপ্তারের পরদিন মুশফিক মহানগর হাকিম আবু সালেম মো. নোমানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, “টাকা না পেয়ে নিজেই তার দাদী ও ফুপুকে হত্যা করে লাশ পানির ট্যাংকে ফেলে দিয়েছিলেন।”

এরপরও তদন্ত চালিয়ে যান পরিদর্শক ইলিয়াছ খান। নিহত মেহেরুন্নেসার খোয়া যাওয়া মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার মো. মুসলিম (২৫) নামে এক রাজমিস্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেন তারা। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে মেহেরুন্নেসার প্রতিবেশী মো. মাসুদ রানা (৩৯) ও মো. শাহাবউদ্দিন ওরফে সাবু ওরফে মুছা (৩৭) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানান।

মাসুদ রানার বাসা মেহের মঞ্জিলের পাশে। আর রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত শাহাবউদ্দিন থাকেন ওই এলাকায় রেলওয়ে কোয়ার্টারে। মেহের মঞ্জিলের পাশে তিনি মাসুদ রানার কাছ থেকে জায়গা কিনে ঘর তৈরি করছিলেন। মুসলিম ছিলেন তার রাজমিস্ত্রী।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম বৃহস্পতিবার বলেন, তাড়াহুড়ো করলে অনেক সময় মূল অপরাধী পার পেয়ে যায়। তাই মামলার তদন্তে একটু ‘ধীরে চলছিলেন’ তারা।

“মুশফিক আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পরও তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তে লেগে ছিলেন। তদন্তে মুশফিক ছাড়া আরও চারজনের এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

এই হত্যাকাণ্ডে মুন্না নামে আরেকজনের নাম এসেছে জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ইলিয়াছ বলেন, মুশফিকের স্ত্রীর বড় ভাই মুন্নাকে গ্রেপ্তারের জন্য খুঁজছেন তারা। 

মুসলিম বুধবার হত্যাকাণ্ডে দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন বলে জানান তিনি।

গ্রেপ্তার শাহাবউদ্দিন ও মাসুদ রানা

পরিদর্শক ইলিয়াছ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হত্যাকাণ্ডের পর মেহেরুন্নেসার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন খোয়া গিয়েছিল। তার একটি উদ্ধারের পর মুসলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

“মুসলিমকে গ্রেপ্তারের পর সেও প্রথমে বলে, একাই দুইজনকে খুনকে করেছে। মুশফিক বা অন্য কেউ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল না। পরে সে হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলে এবং ঘটনার সাথে জড়িত সে ছাড়া আরও তিনজনের নাম প্রকাশ করে আদালতে জবানবন্দি দেয়।”

হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা সবাই মেহেরুন্নেসার পূর্ব পরিচিত জানিয়ে তিনি বলেন, মাসুদ তাদের জায়গা নিয়ে চলা বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমায় সহায়তা করেছিলেন। আর মুসলিম তাদের বাসায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করেছিলেন।

“আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মুসলিম বলেন, শাহাবউদ্দিনের নির্দেশে হত্যাকাণ্ডের ওই রাতে সাড়ে ১২টার দিকে সে ওই বাসায় যায়। মুসলিম ভবনে ঢুকে মূল দরজা খুলে দেয়। এরপর সেখানে মেহেরুন্নেসার ভাইপো মুশফিক, তার স্ত্রীর বড় ভাই মুন্না, মাসুদ, শাহাবউদ্দিন বাসায় প্রবেশ করে। সে, শাহাবউদ্দিন ও মাসুদ বাসায় ঢুকে অন্য একটি রুমে অবস্থান নিলেও মুশফিক মুন্নাকে নিয়ে তার ফুপু মেহেরুন্নেসার রুমে প্রবেশ করে।

“চেক বইতে স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য রুমে মেহেরুন্নেসার সাথে তাদের কথা কাটাকাটি হয় উল্লেখ করে মুসলিম আরও বলে, কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির পর মুশফিক তার তার ফুপুকে (মেহেরুন্নেসা) গামছা দিয়ে হাত ও মুখ বেঁধে সিঁড়িঘরে নিয়ে আসে। সেখানে দলিল ও কাগজে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ সৃষ্টি করলেও মেহেরুন্নেসা রাজি হয়নি। এ সময় মুশফিক পিঁড়ি দিয়ে মেহেরুন্নেসার মাথায় আঘাত করে।

“ওই সময় মুশফিক হাতে গ্লাভস দিয়ে মেহেরুন্নেসার গলা চিপে ধরে এবং তাকেও কাপড় দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরতে বললে সে ধরে। মৃত্যু নিশ্চিত করে সে ও মুশফিক মিলে হাত, পা বাঁধা অবস্থায় লাশটি পানির ট্যাংকে ফেলে দেয়।”

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মুসলিম মেহেরুন্নেসার মা মনোয়ারা বেগমকেও হত্যার বিবরণ দিয়েছেন বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা।

“মুসলিম বলেছে, মেহেরুন্নেসাকে হত্যার পর মাসুদ, শাহাবউদ্দিন ও মুন্না মিলে মনোয়ারাকে কোলে করে রুম থেকে বের করে সিঁড়িঘরে নিয়ে আসে। এ সময় মনোয়ারাকেও দলিল ও চেক বইয়ে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দিলে তিনি রাজি হয়নি।

“মাসুদের নির্দেশে মুসলিম মনোয়ারার গলা চেপে ধরে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করে তার লাশটিও পানির ট্যাংকে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর মুসলিম মেঝেতে পড়া রক্ত পরিষ্কার করে দেয়।”

তদন্ত কর্মকর্তা ইলিয়াছ বলেন, “দুজনকে হত্যার পর মুন্না ঘর থেকে কোরআন শরীফ এনে কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে নিজের নাম ছাড়া অন্য কারো নাম না বলবে না বলে শপথ করিয়েছিলেন বলে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন মুসলিম।   

“শপথ নেওয়ার পর সবাই মূল দরজা দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলে মুসলিম ঘরের ভেতরের থেকে দরজা বন্ধ করে পেছনে দেয়াল টপকে বাসা থেকে বের হয়ে আসে বলে আদালতকে জানায়।”  

এদিকে শাহাবউদ্দিন ও মাসুদ রানাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে আনার আদেশ দিয়েছে আদালত।

ইলিয়াছ খান জানান, দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল। আদালত শুনানি শেষে দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।

জমি দখলের লোভ নাকি অন্য কোনো কারণে মাসুদ রানা ও শাহাবউদ্দিন ‘এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন’, তা জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।