প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ এবং সিসিটিভির ভিডিও দেখে চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই বছরে উগ্রপন্থিরা দেশে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তার সঙ্গে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যার মিল পাচ্ছেন তারা।
Published : 05 Jun 2016, 06:08 PM
রোববার সকাল পৌনে ৭টায় ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে নগরীর জিইসি মোড়ে যাওয়ার সময় খুন হন চট্টগ্রামে জঙ্গি দমনে বেশ কয়েকটি অভিযানে নেতৃত্বদাতা পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের স্ত্রী মিতু।
মোটর সাইকেলে করে আসা তিন হামলাকারী জিইসি মোড়সংলগ্ন মিষ্টির দোকান ওয়েল ফুডের সামনে মাহমুদা আক্তার মিতুকে প্রথমে ছুরি মারে এবং পরে মাথায় গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে তারা কাজ শেষ করে সরে যায় বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনার (উত্তর) পরিতোষ ঘোষ বলেন, ওই সড়কের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে হত্যাকারীরা তিনজনই ছিল। মোটর সাইকেল নিয়ে তারা আগে থেকেই ওই এলাকায় অবস্থান করছিল বলে ভিডিও দেখে মনে হয়েছে।
“তারা মাহমুদা আক্তারের শরীরের বিভিন্ন অংশে স্ট্যাব করে। তারপর মাথার বাঁ দিকে গুলি করে মোটর সাইকেলে করে পালিয়ে যায়।”
হত্যাকাণ্ডের সময় মিতুর সঙ্গে থাকা তার ছয় বছর বয়সী ছেলে সকালে ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছিল, তার সঙ্গে মিলে গেছে সিসিটিভি ফুটেজের বর্ণনা।
হামলাকারী তিনজনের মধ্যে একজনের মাথায় হেলমেট ছিল বলেও পরিতোষ ঘোষ জানান।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, হামলাকারীরা আগে থেকেই রাস্তার বিপরীত পাশে মোটর সাইকেল থেকে নেমে অবস্থান করছিল।
“ফুটেজে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে একজন চাপাতি জাতীয় কোনো একটি অস্ত্র দিয়ে মিতুকে কোপায়; গুলি করে আরেকজন। হত্যাকাণ্ড ঘটাতে তারা ৪৫ থেকে ৫০ সেকেন্ড সময় নেয়।”
চলতি বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে সন্তগৌরীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়, এবং গতবছর আশুলিয়ায় পুলিশ হত্যা, দিনাজপুরে ইতালীয় এক পাদ্রীকে হত্যাচেষ্টার ঘটনাতেও হামলাকারী ছিল তিনজন। মোটর সাইকেলে আসে, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ছুরি, চাপাতি, পিস্তল।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ ও র্যাব। বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিতোষ ঘোষ বলেন, “বাবুল আক্তার জঙ্গি গোষ্ঠী দমনে কাজ করেছে। আমরা বিষয়গুলো মাথায় রেখেই তদন্ত করছি। হত্যাকারীদের ধরতে র্যাব-পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে।”
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাতে নিহতের স্বামী এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা করেছেন।
দুপুরে বাবুলের বাড়িতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, খুনিদের ‘শিগগিরই’ ধরার বিষয়ে তিনি আশাবাদী।
পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে কিছুদিন আগে ঢাকার পুলিশ সদরদপ্তরে যোগ দেওয়ার আগে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হিসেবে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উত্তর-দক্ষিণ জোনের দায়িত্বে ছিলেন বাবুল আক্তার।
গত দুই বছরে চট্টগ্রামে জঙ্গি দমন অভিযানে সাহসিকতার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। বলা হয়, তার তদন্তের জোরেই পুলিশ জেএমবির একটি আস্তানার খোঁজ পায়, গ্রেপ্তার করা হয় ওই জঙ্গি দলের সামরিক শাখার প্রধানকে।
গত বছর চট্টগ্রামে কয়েকটি ডাকাতি ঘটনার অনুসন্ধান চালিয়ে তাতে জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি উদ্ঘাটন করেন বাবুল। তার নেতৃত্বে পরিচালিত একাধিক অভিযানে জেএমবির বিপুল অস্ত্রের মজুদও ধরা পড়ে।
পুলিশের তদন্ত ব্যুরোর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক কবির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, হামলাকারীরা হত্যকাণ্ডে ৭ দশমিক ৬৫ বোরের পিস্তল ব্যবহার করেছে। ঘটনাস্থলে পাওয়া গেছে তিনটি বুলেট ও একটি বুলেটের খোসা।
“তিনটি বুলেটের মধ্যে একটি মিস ফায়ার হয়েছে, অন্য দুটি ‘লাইভ’ বুলেট,” বলেন তিনি।
কবির হোসেন জানান, মাহমুদা আক্তার মিতুর পাঁজর, বুক, পেট, হাত ও পিঠে মোট আটটি কোপ ও মাথার বাঁ পাশে গুলির ক্ষত রয়েছে।
র্যাবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০৮ সালে সিএমপির কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার হিসেবে বদলি হয়ে আসেন বাবুল আক্তার। এরপর চট্টগ্রামের হাটহাজারি সার্কেলের এএসপি ও কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন শেষে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হিসেবে যোগ দেন।
গত এপ্রিলে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবারই ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।