একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা চরম নির্যাতিত নারীদের আত্মত্যাগের কথা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
Published : 30 Dec 2014, 11:31 PM
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর্যবেক্ষণে এই মন্তব্য করে।
একাত্তরে রংপর অঞ্চলের আল বদর নেতা আজহারের বিরুদ্ধে মামলার প্রথম সাক্ষী ছিলেন একজন বীরাঙ্গনা, যাকে অনেক নারীর মতো ধরে নিয়ে গিয়েছিল আজহার ও পাকিস্তানি বাহিনী, করা হয়েছিল ধর্ষণ। তার জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছিলেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ।
একাত্তরের ধর্ষণের বেদনা চেপে চার দশক পর আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে পক্ষে রায় পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় রংপুরের বীরাঙ্গনা মানসুরা বলেছেন, “লম্পট আজহারের ফাঁসির রায় হওয়ায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। ফাঁসি কার্যকর হলে শান্তিতে মরতে পারব।”
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, “বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের ত্যাগ ও কষ্টকর অভিজ্ঞতার ইতিহাসকে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে।
“যাতে বীরঙ্গনাদের আত্মত্যাগ, পাকিস্তান দখলদার ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল বদর ও আল শামসের যৌন সন্ত্রাসসহ বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে তারা জানতে পারে।”
রায়ে আদালত বলেন, আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ অনুসারে ট্রাইব্যুনাল ন্যায়বিচার নিশ্চিতে দণ্ডবিধির সহযোগিতা নিতে পারেন। ১৯৭৩ সালের আইনের ২০(২) ধারা দণ্ডবিধির ৫৩ ধারা অনুসারে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সে অনুসারে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সশ্রম বা সাধারণ দণ্ড, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত বা জরিমানা করতে পারে।
“তবে অপরাধী থেকে অপরাধের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়ার বিধান আমরা ৭৩’র আইন বা দণ্ডবিধি কোথাও পাইনি। প্রসিকিউশন তুরিন আফরোজও এতে একমত পোষণ করেছেন। এ কারণে আমরা আজহার থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে একাত্তরে যৌন সন্ত্রাসের শিকার প্রসিকিউশনের ১ নম্বর সাক্ষীকে দেওয়ার আদেশ দিতে পারিনি।”
এরপরই আদালত বলে, “কিন্তু আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের উচিত আর দেরি না করে এই বীরাঙ্গনাসহ (মানসুরা) সকল বীরঙ্গনাকে যথাযথভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন করা। কারণ তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত এবং সম্মানিত বীরাঙ্গনা। সমাজে তাদেরকে গ্রহণ, স্বীকৃতি এবং সম্মানিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তারাও জাতির অহঙ্কার।”
১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সম্মান জানান। তার নির্দেশনায় বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়, যা ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত চলছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সামরিক শাসকদের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানি জান্তার সহযোগীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মানসহ অন্য সব সুবিধা পাবেন।