বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যাদের এতদিন বীরাঙ্গনা বলে ডাকা হত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2014, 03:08 PM
Updated : 14 Oct 2014, 03:24 AM

সেই সঙ্গে একাত্তর সালে যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে ছিল, তাদের বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা ঠিক করা হয়।

সোমবার রাজধানীর মগবাজারে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) কার্যালয়ে জামুকার ২৫তম সভায় এই সব সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সভা শেষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যাদের বয়স কমপক্ষে ১৫ ছিল তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্তির আবেদন করতে পারবেন।

“যুদ্ধকালীন ১৫ বছর বয়সের নিচে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্তির আবেদন করতে পারবেন না।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেমেছিল এক লাখের বেশি মানুষ, যার মধ্যে অনেক কিশোরও ছিল। এদের একজন ১৩ বছর বয়সী শহীদুল ইসলাম লালু বীর প্রতীক খেতাবও পেয়েছেন।

বয়স নির্ধারণের বিষয়ে মন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা হিসেব করেছি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র নিয়ে ট্রেনিং নিতে হলে তার বয়স ১৫ বছর না হলে রাইফেল চালানো শেখা স্বাভাবিকভাবে সম্ভব না।”

বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর কোলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম লালু বীর প্রতীক। এই ছবিটি আলোকচিত্রী আফতাব আহমেদের তোলা।

তবে এর ব্যতিক্রম রয়েছে স্বীকার করে তিনি সেই বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

“মুক্তিযুদ্ধের সময় নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলের বয়স ১৫ বছরের মধ্যে ছিল, তবে ব্যতিক্রম কিছু থাকতে পারে। সেই সংখ্যা আলাদাভাবে খতিয়ে দেখা হবে, এখন না।”

বয়স নির্ধারণে একাত্তরের ২৬ মার্চকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসাবে মোজাম্মেল বলেন, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল।

“তবে ওই সময়েও বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বা মুক্তিযুদ্ধের জন্য অনেকে আত্মাহুতি দিয়েছেন। তবে ২৬ মার্চের আগে ধরলে স্বাধীনতার আগে হয়ে যায়।”

নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণের বিষয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ না থাকায় অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন। এজন্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কথা উঠছে। তাই সুনির্দিষ্টভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় থাকা অনেকে ভুয়া বলে প্রমাণিত হওয়ার পর নানা সময় তা নিয়ে বিতর্ক উঠছিল। তাই বিভিন্ন তালিকা সন্নিবেশিত করে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। 

এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে হাই কোর্ট এক আদেশে বীরাঙ্গনাদের কেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না, তা জানতে চায় সরকারের কাছে।

নতুন সংজ্ঞায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে নির্যাতিত নারীরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হতে পারবেন।

স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না দেওয়াকে ‘দুঃখজনক ঘটনা’ বলে মন্তব্য করেন মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল।

“দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কারণ অনেকেই মারা গেছেন, সম্মান ভোগ করে বা জেনেও যেতে পারেননি।”

মন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গবেষকদের কাছে বীরঙ্গনাদের এলাকাভিত্তিক তালিকা থাকলেও তা সম্পূর্ণ নয়। বিভিন্নভাবে মন্ত্রণালয় বীরাঙ্গনাদের তালিকা সংগ্রহ করেছে। উপজেলাভিত্তিক কমিটি ও নারী সদস্যদের দিয়ে বীরাঙ্গনাদের বিষয়টি যাচাই করা হবে।

“কোন উপজেলায় কে ধর্ষিতা হয়েছিলেন তা আর অজানা থাকার কথা নয়। তবে গোপনীয়তার সঙ্গেই এগুলো সংগ্রহ করা হবে। কারণ অনেকে বৃদ্ধ বয়সে এসে প্রকাশ্যে তা বলতে চাইবেন না।”

বীরাঙ্গনাদের তথ্য সংগ্রহ করাকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, তবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রকাশ্যে এটা করা হবে না। নারী মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক সংস্থার কর্মী আছেন তাদের দিয়েই এই কাজটি করা হবে।

নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী লাল মুক্তিবার্তা, ভারতের তালিকা (বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের), প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত সনদধারী, প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশের সীমানা পার হয়ে ভারতে গিয়ে নাম অন্তর্ভুক্তকারীরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।

স্বাধীনতার পক্ষে যেসব পেশাজীবী জনমত গঠন করেছেন তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পাবেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়, স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা গ্রহণকারী সাংবাদিকরা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হতে পারবেন।

আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রূষাকারী চিকিৎসক, নার্স ও তাদের সহকারীরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন।  

মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, এমএলএ ও এমপিরা নতুন সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বিবেচিত হবেন।

বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের অধীনে স্থাপিত অফিসগুলোর দাপ্তরিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও নতুন সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হতে পারবেন।

নতুন সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাওয়া কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী।

তিনি বলেন, নতুন সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে অনলাইনে আবেদন করতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই-বাছাইয়ের পর আগামী ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করে তাদের পরিচয়পত্র দেওয়া হবে বলে আগে জানিয়েছিলেন মন্ত্রী মোজাম্মেল হক।

জামুকের সভায় নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, সাবেক প্রধান হুইপ আব্দুস শহীদ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান সভায় উপস্থিত ছিলেন।