মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারিয়ে সমালোচনার মুখে কানাডায় পাড়ি জমাতে গেলেও ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন মুরাদ হাসান।
Published : 12 Dec 2021, 04:56 PM
দেশ ছাড়ার দুদিন পর রোববার বিকালে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার এমিরেটসের একটি ফ্লাইটেই তিনি রওনা হয়েছিলেন টরন্টোর পথে। কিন্তু কানাডায় ঢুকতে না পেরে তিনি দুবাইয়ে ফিরে সেখানেই ছিলেন।
দুবাই থেকেই রোববার বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে এমিরেটসের যে ফ্লাইট আসে, তাতেই মুরাদ দেশে ফেরেন বলে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ইমিগ্রেশন) মো. আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে ইমিগ্রেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রিফিউজড প্যাসেঞ্জারদের এয়ারলাইন কর্তৃপক্ষ পাসপোর্টসহ আমাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়। উনাকেও (মুরাদ) হস্তান্তর করা হয়েছে।”
মুরাদের মোবাইল ফোনটি বিকাল থেকে খোলা পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেই নম্বরে ফোন করলেও তিনি তা কল ধরছেন না।
তিনি বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে বেরিয়ে যান বলে পুলিশের বিশেষ শাখার এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
মুরাদের যাওয়া কিংবা ফিরে আসার বিষয়ে তার পরিবার কিংবা তার সংশ্লিষ্ট কারও কোনো বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
মুরাদ কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে রওনা হলেও দুবাইয়ে তার ভিসা ছিল না বলে তাকে ফিরে আসতে হচ্ছে বলে এর আগে মন্ত্রিসভার একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন।
তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব এবং আওয়ামী লীগের পদ হারালেও মুরাদ হাসান এখনও সংসদ সদস্য রয়েছেন।
টেলিফোনে এক চিত্রনায়িকাকে অশালীন মন্তব্য এবং হুমকি দেওয়ার অডিও ফাঁস হওয়ার পর গত সোমবার মুরাদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেদিন থেকে অগোচরে থাকা মুরাদ পরদিন পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলে তা গৃহীত হয়। একই দিনে জামালপুর আওয়ামী লীগের পদ থেকেও তাকে সরানো হয়।
এরপর মুরাদের কোনো খোঁজ না মিললেও বৃহস্পতিবার রাতে তিনি ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। তখন জানা যায়, কানাডা যেতে এমিরেটসের ফ্লাইটে উঠছেন তিনি। মধ্যরাতে ফ্লাইটটি ঢাকা ছেড়ে যায়।
কিন্তু টরেন্টোর পিয়ারসন বিমানবন্দরে মুরাদকে ‘আটকে দেওয়া হয়’ বলে কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর খবর দেন।
কানাডা থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার নিউজ পোর্টাল নতুন দেশের সম্পাদক সাগর এক প্রতিবেদনে লেখেন, “সংসদ সদস্য ডা. মুরাদ হাসানকে কানাডায় ঢুকতে দেয়নি দেশটির বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি। টরন্টোর পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। কানাডায় বসবাসরত তার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। তবে কানাডার সরকারি সূত্র থেকে এই ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।”
তথ্য প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে মুরাদ বেশ কয়েকবার কানাডা সফর করে। গত সেপ্টেম্বরেই তিনি সপ্তাহখানেক ওই দেশে ছিলেন।
এবার কানাডায় যাতে মুরাদকে ঢুকতে দেওয়া না হয়, সেজন্য প্রবাসীদের একটি অংশ সক্রিয় ছিল বলে জানান ‘লুটেরা বিরোধী মঞ্চ, কানাডা’র সংগঠক ও ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পিএইচডির গবেষক মঞ্জুরে খোদা টরিক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কানাডায় খুব নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব হয়। আমরা এখানে কানাডার বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সির ওয়েবসাইটে গিয়ে ইমেইল করেছি। মেইলে লিখেছি মুরাদ হাসানের অপকীর্তির কথা, আর সঙ্গে সংবাদ ও ভিডিও ক্লিপ জুড়ে দিয়েছি।
“১৭১টি ইমেইল নাকি গিয়েছে, আমাদেরকে জানিয়েছেন এখানে কর্মরত দুই বাংলাদেশি সাংবাদিক।... তাকে কানাডায় ঢুকতে না দেওয়ার ব্যাপারে আমার বিশ্বাস এটি কাজে দিয়েছে।”
অবশ্য ঢাকায় কানাডীয় হাই কমিশনের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে যেসব কাগজপত্র থাকা প্রয়োজন ছিল, তা না থাকায় মুরাদ হাসানকে বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়।
টিকার সনদ ও কোভিড নমুনা পরীক্ষা ছাড়া ঢাকার বিমানবন্দর মুরাদ কী করে পার হলেন- রোববার শাহজালাল বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলন পেয়ে সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল বেসামরিক বিমান চলাচল প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীকে।
জবাবে তিনি বলেন, “বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য বিভাগের পৃথক ডেস্ক রয়েছে। টিকার সনদের বিষয়টি তারা পরীক্ষা করে থাকে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) তাদের বসার জায়গা করে দিয়েছে মাত্র।”
এ বিষয়ে জানতে হলে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন প্রতিমন্ত্রী।
একই প্রশ্নের জবাবে বেবিচকের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তৌহিদুল আহসান বলেন, এ বিষয়ে তিনি ‘খোঁজখবর’ করবেন।
জামালপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়ার রহমান তালুকদারের ছেলে মুরাদ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হন।
২০১৯ সালে শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভায় প্রথমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুরাদকে। কয়েকমাস পরে তাকে সরিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনিকে নিয়ে বর্ণ ও নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে সমালোচনায় পড়েন মুরাদ হাসান।
এর কয়েকদিনের মধ্যে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে তার অশালীন আচরণের একটি অডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিয়ে মুরাদের অশালীন বক্তব্যের অডিও ছড়িয়ে পড়ে।
এসব নিয়ে চাপে পড়ে মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারাতে হয় মুরাদকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিয়ে কটূ মন্তব্যের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ছাত্রলীগের এক নেতা।
এদিকে খালেদা জিয়ার নাতনিকে নিয়ে মন্তব্যের জেরে রোববারই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার কয়েকটি আবেদন হয়েছে। মুরাদের বিরুদ্ধে এই মামলার আবেদন করেছেন বিএনপি সমর্থকরা।