এমনকি, সরকারের উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্মচারীরাও যখন গণমাধ্যমে কোনো কারণে উপস্থিত তখনও তাদেরকে বাংলা ইংরেজির অপ্রয়োজনীয় মিশেলে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। অথচ রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
Published : 21 Feb 2023, 02:08 PM
লড়াই করে, রক্ত দিয়ে নিজের ভাষার প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি আদায় করেছে--ইতিহাসে খুব কম জাতির জীবনেই এমন ঘটেছে। বাঙালি এই অর্থে ব্যতিক্রম। বাঙালি ব্যতিক্রম এই অর্থেও যে নিজের ভাষাকে সে ঘৃণা করেছে, অবহেলা করেছে, এমনকি বিরোধিতাও করেছে। এই বিরোধিতায় কেবল বাঙালি মুসলমান নয়, বাঙালি হিন্দুও ছিল। এবং এই বিরোধিতার উৎস মূলত ধর্মান্ধতা ও ক্ষমতাকাঠামো; মুসলমান যেমন আরবি ভাষাকে পবিত্র মনে করে বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করেছে, তেমনি হিন্দু সম্প্রদায় সংস্কৃতকে পবিত্র জ্ঞান করে বাংলার বিরোধিতা করেছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই দুই সম্প্রদায়ই পরাজয় মেনে নিয়েছে বাংলা ভাষার কাছে।
বাংলা ভাষার জন্য একদিকে ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই এবং অন্যদিকে, এই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটাই এক সময় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াই হয়ে উঠেছিল। ৫২-এর ভাষা-আন্দোলন ও ৭১-এর বিজয় আমাদের ভাষার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করলেও, এই ভাষার বিপদ কিন্তু এখনও কাটেনি। স্বাধীনতার পর আজ এই ভাষার বিরুদ্ধে বিপদগুলো সরাসরি বিরোধিতার রূপে আসছে না, আসছে চোরাগুপ্তা পথে; কিন্তু এই বিরোধিতার উৎস সেই পূর্ববর্তীদের মতোই ক্ষমতা ও ধর্মীয় বোধ। আরবি, ফারসি ও উর্দু জানার কারণে ক্ষমতাকাঠামোর নিকটবর্তী ছিল যে-শ্রেণি, আজকের বাংলাদেশে ওইসব ভাষায় দখলদারীরা ক্ষমতাকাঠামোয় আর নেই বটে, কিন্তু আরবির আধিপত্য তাতে করে কমে যায়নি। ক্ষমতাকাঠামোয় এখন আরবি, ফারসি ও উর্দুর পরিবর্তে ইংরেজির দাপট; কিন্তু সমাজে, বিশেষ করে বৃহ্ত্তর নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে আরবির আধিপত্য ক্রমশই বাড়ছে। এটা বাড়ার মূল কারণ বেশিরভাগ মানুষের দ্রুতগতিতে ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পরা। ক্ষমতা ও ধর্ম-- এই দুটোই হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার দুই নিয়ামক শক্তি: একটি ইহকালের প্রত্যক্ষ প্রয়োজন মেটায়, অন্যটি পরকালের। এই দুটি প্রধান প্রয়োজনের সাথে মাতৃভাষা বাংলা নয়, বরং ভিনদেশি দুই ভাষা ইংরেজি ও আরবি জড়িয়ে আছে। বাংলা ভাষা সরকারি অফিস আদালতে নামকাওয়াস্তে আছে বটে, কিন্তু তার অবস্থা খুবই নাজুক। পিয়ন ও দফতরির কাছে টুটাফাটা ইংরেজি, আর কর্মকর্তাদের লেখায় ও কথায় তেল চকচকে ইংরেজির কদর যতটা আছে, বাংলার প্রতি অবহেলা তার চেয়ে বহু গুণ বেশি। অর্থাৎ বাংলা ভাষার প্রতি ঘৃণা ও বিরোধিতার স্বরূপ বদলালেও, দার্শনিক জায়গা থেকে মনোভঙ্গির বদল ঘটেছে খুম কমই। ফলে আমরা যাকে ভাষার বিজয় ও প্রতিষ্ঠা ধরে নিয়েছি তার মর্মে এখনও বিরাট গলতি রয়ে গেছে। আর এই গলতি কেবল অফিস আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, বিভিন্ন সামাজিক ও টিভি চ্যানেলের মতো গণমাধ্যমগুলোতেও রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা অনেকটা কাজীর গরু কেতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই। সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারী আদেশ নিষেধ বাংলায় লিখিত হলেও, নির্দেশদাতাদের ব্যবহারিক জীবনে ওই ভাষার কদর খুব একটা নেই। এই না-থাকার কারণ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক। একক ভাষা হিসেবে উত্তম রূপে বাংলা জানা কোনো ব্যক্তির পক্ষে তিরিশ হাজার টাকা বেতনের কোনো চাকরী তার পক্ষে পাওয়া সম্ভব কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু আরবি বা ইংরেজি উত্তম রূপে জানা থাকলে আপনি তিরিশ নয়, লক্ষ টাকা বেতনের একটি চাকরী জুটিয়ে ফেলতে পারবেন অনায়াসে। যে-লোকটি ইংরেজিতে বা আরবিতে অনর্গল কথা বলতে পারছেন, তাকে আমরা সম্ভ্রমে ও ভয়ে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু বাংলায় যখন ওই পারদর্শিতা থেকে কেউ কথা বলছেন তখন তাকে আমরা ভয় পাচ্ছি না, এবং তার কোনো কদরও নেই। এই না-থাকার কারণ বাংলা ভাষাটির আর্থিক মূল্য এই সমাজে ও রাষ্ট্রে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে কতটা ধর্মীয় ও ঔপনিবেশিক কারণ নিহিত তা সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন।
বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলার সবচেয়ে দৃষ্টিকটু রূপটি আমরা দেখতে পাবো টেলিভিশনের নাটক ও টকশোগুলোতে। টেলিভিশনের নাটকে অকারণে ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে চরিত্রগুলোর মুখে এত বেশি ইংরেজি শব্দ ও বাক্য উচ্চারিত হতে দেয়া যায় যে তাতে করে মনে হওয়া স্বাভাবিক চরিত্রগুলো সম্ভবত বাংলা ও ইংরেজি-- দুটোর কোনটিই সম্পূর্ণ রূপে আয়ত্ত করতে পারেনি, তাই খণ্ডিত দুই ভাষার সাহায্যে সে তার মনের ভাব প্রকাশ করছে। আমি ভুলে যাচ্ছি না যে কোনো কোনো কাহিনিতে চরিত্রের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের মূলানুগতার স্বার্থে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার দেখাতে হতে পারে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এসব ইংরেজি শব্দ বা বাক্য সেই প্রয়োজন থেকে নয়, স্রেফ বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা ও ইংরেজি ভাষার প্রতি আসক্তি থেকে করা হচ্ছে। টকশোগুলো হচ্ছে এই অবহেলা ও আসক্তির সবচেয়ে অমাার্জিত ও অবমাননাকর নজির। বোধহয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছাড়া, আমি এ পর্যন্ত যত অংশগ্রহণকারী দেখেছি তারা প্রায় প্রতিটি বাক্যে ইংরেজি শব্দ, এমনকি ইংরেজি সম্পূর্ণ বাক্য পর্যন্ত বলছেন। তিনি যে ইংরেজি শব্দ বা বাক্যগুলো বলছেন তা বাংলায় সহজেই প্রকাশযোগ্য, কিন্তু দ্বিতীয় ভাষা জানার বাহাদুরী দেখাবার জন্য তাকে ইংরেজি বলতে হয়। অপর কোনো ভাষার প্রতিই আমার বিরাগ নেই, বরং বলা যায় আমার তীব্র আসক্তি আছে অন্য ভাষার প্রতি। কিন্তু যেখানে মাতৃভাষায় বলা সম্ভব এবং যে-মাধ্যমের দর্শক বাংলাভাষী, সেখানে ইংরেজি শব্দ বা বাক্য বলার প্রয়োজন হয় কেন? আমি একথা মোটেই বলতে চাইছি না যে গণমাধ্যমে আলোচনায় বা কথাবার্তায় বিদেশি ভাষায় উল্লেখ আসতে পারবে না। আসতে পারে আলোচনার সূত্রে, কিন্তু সেটা নিজের বক্তব্যকে প্রমাণের জন্য বা সূত্র হিসেবে উল্লেখ করার স্বার্থে বিদেশি কোনো জ্ঞানী ব্যক্তির ব্ক্তব্য উদ্ধৃত হতে পারে, তবে সঙ্গে সঙ্গে সেটার বাংলা তর্জমাও থাকা উচিত। আমাদের বক্তারা কি সেটা করেন? গণমাধ্যমে কথা বলার জন্য যে দায়িত্ববোধ থাকার কথা তা এই বক্তা বা আয়োজক--তাদের কারোরই নেই। যেটা আরও বেশি আপত্তিকর তা হলো বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর জনপ্রতিনিধিরা পর্যন্ত এই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। এমনকি, সরকারের উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্মচারীরাও যখন গণমাধ্যমে কোনো কারণে উপস্থিত তখনও তাদেরকে বাংলা ইংরেজির অপ্রয়োজনীয় মিশেলে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। অথচ রাষ্ট্রভাষা বাংলা। পৃথিবীর অন্য কোন ভাষার জনগোষ্ঠী নিজের ভাষার সাথে এই ধরনের বেইমানী করেন বলে মনে হয় না। রাশিয়াতে দীর্ঘদিন ছিলেন এবং রুশ ভাষা জানেন এমন দুজন প্রিয় কথাসাহিত্যিক দীপেন ভট্টাচার্য এবং মশিউল আলমের কাছে আমি কৌতূহলবশত জানতে চেয়েছিলাম রাশিয়াতে রুশ জনগোষ্ঠী কথা বলার সময় ইংরেজি শব্দ কতটা প্রয়োগ করেন। তারা দুজনই তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন যে রুশরা ইংরেজি শব্দ তাদের বাক্যে প্রয়োগ প্রায় করেনই না বলা যায়। প্রথম কারণ হলো, ইংরেজিতে তিনি যা বলতে পারতেন সেটা তার ভাষাতে আছেই, সুতরাং কেন তিনি ইংরেজিতে বলতে যাবেন। স্প্যানিশভাষী মেক্সিকোর পাশেই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মেক্সিকানরা যখন মাতৃভাষায় কথা বলে তখন তাদের মধ্যে রুশদের মতোই ইংরেজি শব্দ বা বাক্য প্রয়োগের কোনো প্রবণতা চোখে পড়ে না। তার মানে এই নয় যে স্প্যানিশ বা রুশ পুরোপুরি ইংরেজি বা ভিন্ন ভাষার স্পর্শ এড়িয়ে শত ভাগ খাঁটি। কোনো ভাষাই পুরোপুরি খাঁটি নয়, হওয়া সম্ভবও না। ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কারণে এক ভাষার সাথে আরেক ভাষার লেনদেন ঘটে, সেই লেনদেনের কারণে একটি ভাষা অন্য ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে। যেমনটা করেছে স্প্যানিশ ভাষা আরবি ভাষা থেকে। সাত/আট শ বছরের আরবিভাষী শাসকদের অধীনে থাকার ফলে প্রায় চার হাজার শব্দ প্রবেশ করেছে স্প্যানিশ ভাষায়। আমাদের বাংলা ভাষায়ও ওই একই কারণে আরবি, ফার্সি এবং ইংরেজি শব্দ প্রবেশ করেছে। কিন্তু সেটা ঘটেছে ভাষার স্বাভাবিক লেনদেনের কারণে। এবং এটা সব ভাষার ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। কিন্তু আত্তীকৃত বিদেশি শব্দগুলো আশ্রিত ভাষার ব্যাকরণ, উচ্চারণ ও বিবর্তনের ঐতিহাসিক শর্ত মেনে নিয়ে এখন মাতৃভাষারই অংশ হয়ে উঠেছে। সুতরাং আমার আলোচ্য বিষয় ভাষার এই স্বাভাবিক লেনদেন নয় মোটেই। যারা নিজের ভাষার প্রতি হীনম্মন্যতা থেকে বিদেশি ভাষা প্রয়োগের আধিতে ভোগেন, আমি তাদের কথাই বলছি। এই আধির পেছনে কেবল ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রের উদাসীনতাও দায়ী। বলা হয়ে থাকে ভাষা নদীর মতো প্রবহমান। কথাটা আংশিক সত্য। নদীকে আমরা মেরে ফেলতে পারি আবার নদীর সুরক্ষাও দিতে পারে। অনেক নদী প্রাকৃতিক কারণে মরে যায়। আবার কৃত্রিমভাবে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা নদীকে হত্যাও করতে পারি। ভাষার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক সংকট বা দাপটের অভাবে পৃথিবী থেকে অনেক ভাষাই উধাও হয়ে গেছে। আবার বহু বছর যাবৎ অব্যবহৃত ভাষাকে আবার ফিরিয়েও এনেছে, যেমন হিব্রু। ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিব্রুকে বেছে নেয়া হয়েছিল। অথচ হিব্রু, সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়: “ অন্তত হাজার বছর ধরে কেউ কথা বলে নি, সাহিত্য সৃষ্টি করে নি--শুধু পড়েছে মাত্র, তাও শুধুমাত্র ইহুদি যাজক পণ্ডিত রাব্বি সম্প্রদায়।” (সৈয়দ মুজতবা রচনাবলী,দশম খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পঞ্চম মুদ্রণ মাঘ ১৪০১, পৃ-২৪৪) তারপরও ইজরাইল এই হিব্রুকে রাষ্ট্রভাষা করেছে এবং মুজতবা আলীর ভাষায়: “ইহুদিরা এই অলৌকিক কর্মটি প্রায় সমাধান করে এনেছে।” এই উদাহরণটা দেয়ার মূল উদ্দেশ্য এটাই দেখানো যে ভাষা সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও ভূমিকা থাকে। বাংলা যদিও আমাদের রাষ্ট্রভাষা, কিন্তু এই ভাষার সুরক্ষায় না আছে রাষ্ট্রের আন্তরিকতা, না আছে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায়ের কার্যকরী উদ্যোগ।
অন্যদিকে, পারিবারিকভাবেও মাতৃভাষার প্রতি সন্তানদেরকে যতটা উৎসাহী ও সক্ষম করে তোলা উচিত তার পরিবর্তে দরিদ্র বাবা মা চান নিজের সন্তানকে আরবি ভাষায় দক্ষ করে তুলতে আর মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বাবা মা চান নিজের সন্তানকে ইংরেজিতে দক্ষ করে তুলতে। ফলে বাংলা ভাষা না ঘরকা না ঘাটকা। এটি এখন গরীব জনগোষ্ঠীর নিরুপায় ভাষা হিসেবে টিকে আছে। এবং যতই বড়াই করা হোক না কেন যে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি স্বরূপ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু খোদ বাঙালির মধ্যেই এই ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অভাব সবচেয়ে বেশি।