সব দল রাজি না হলে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার উচিৎ নয় বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা।
Published : 10 Nov 2018, 07:04 PM
সুজন আয়োজিত ‘জাতীয় নির্বাচনী অলিম্পিয়াড’-এ এক প্রশ্নের জবাবে এ মন্তব্য করেন তিনি। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শনিবার সিরডাপ মিলনয়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার প্রধান র্বিাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা আগামী ২৩ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের তারিখ রেখে শহরাঞ্চলের কিছু কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলেন।
সিরডাপ মিলনায়তনের অনুষ্ঠানে শামসুল হুদা তফসিলে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণার সমালোচনা করে বলেন, “নির্বাচন কমিশন তফসিলে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা জোর করে গেলানোর মতো। এতে অসুবিধা হতে পারে বলে আমি মনে করি।”
নিজে প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকার সময় স্থানীয় সরকার নিরবাচনে ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়ার প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন এটিএম শামসুল হুদা।
ইভিএম ব্যবহারে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের নেওয়া পরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তখন আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এটা একেবারে সারাদেশে প্রবর্তন করব না। আগে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখি। সেটাও আবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না। স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচনে ব্যবহার করে পর্যায়ক্রমে আস্তে আস্তে সেটা জাতীয় নির্বাচনে করা হবে।
“কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের পরবর্তী কমিশন যেটা আসল, এটিকে শিকেয় তুলে দিল। এটার উপর আর কোনো কার্যক্রম হল না। আর বর্তমান নির্বাচন কমিশন তো সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে নেমেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটা ব্যবহার করা হবে। যখন অনেক প্রতিবাদ হল, যখন দেখল যে সুবিধা হচ্ছে না, তখন বলা হল এটা হচ্ছে না। তারপর আবার দেখতে পাচ্ছি যে, সীমিত আকারে এখন ব্যবহার করতে চাচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “আমি যদ্দূর জানি বুয়েটের ইলেক্ট্রনিকস ডিপার্টমেন্ট এটার (ইভিএম ডিজাইন তৈরির) দায়িত্বে নেই। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। শুনেছি একটা প্রাইভেট পার্টিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
“এগুলি নিয়ে আমার ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রাইভেট পার্টিকে দিয়ে এরকম একটি সেনসেটিভ বিষয়! এতে যা খুশি তাই হতে পারে। এটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির যে সন্দেহ আছে, মোদ্দা কথা হচ্ছে আপনি একটি ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন করতে চান সকল দলের অংশ গ্রহণে, সেখানে সকল দল যদি এটা করতে রাজি না হয় এরকম একটা বিষয় তো করা উচিৎ না।”
অনুষ্ঠানের সভাপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, “ইভিএম কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বন্ধ করে দিচ্ছে। জার্মনিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে বন্ধ করে দিয়েছে। ইন্ডিয়াতেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। কংগ্রেস বলছে অমরা এটা চাই না। ফুলপ্রুভ সিস্টেম হিসেবে এটা এখনও স্বীকৃত না। তাহলে আমাদের এত প্রয়োজনটা কি?”
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “শুনেছি এই ইভিএমে বায়োমেট্রিক থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই যন্ত্রটা দেখতে কী রকম, এর কী বৈশিষ্ট্য, এটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, কতটুকু নির্ভরযোগ্য কেউ কিছু জানে না।
“শুধু তাই নয়, উন্নত দেশ যেখানে ইভিএম বাদ দিচ্ছে, আমরা সেখানে জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছি কাউকে কিছু না বলে। নির্বাচন কমিশনের তো এটা দায়িত্ব যে, অংশীজনদের ডেকে এটা বোঝানোর বা প্রমাণ করার। এই তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা কেন, কার স্বার্থে? এটাই বড় প্রশ্ন।”
“নভেম্বরের শেষের দিকে তফসিল ঘোষণা করলেই হয়ে যেত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ চলছে, বন্ধ হয়ে গেছে কিনা জানি না। এর মধ্যে তাড়াহুড়া করে নির্বাচন করা হচ্ছে। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত স্কুল-কলেজে পরীক্ষাই চলবে। তাছাড়া বিদেশি পর্যবেক্ষক আসার কথা হয়েছে। আমার ধারণা, এসময় যেহেতু ক্রিসমাস ভেকেশন, বিদেশি পর্যবেক্ষকরা আসবে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা এত তাড়াহুড়ার প্রয়োজনটা কি? এর উত্তর পাচ্ছি না।”
তিনি আরো বলেন, “নির্বাচন যদি ২৩ ডিসেম্বর হয়ে যায়, ২৪-২৫ তারিখের মধ্যে রেজাল্ট হয়ে যাবে। নতুন সংসদ বসবে ২৮ জানুয়ারির পরে। তাহলে একটা মাস আমরা কেন বসিয়ে রাখব তাদের এবং দুইটা সংসদ একত্রে কেন বিরাজমান থাকবে?”
‘নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা কী- এক তরুণ ভোটারের এ প্রশ্নে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, “পর্যবেক্ষকদের জন্য পৃথক একটা আইন বা বিধি আছে নির্বাচন কমিশনের। এই বিধির মাধ্যমে তাকে যেভাবে বেঁধে ফেলা হয়েছে, তাতে পর্যবেক্ষকদের আসলে বেশি কিছু করার নেই।”
মুক্ত গণমাধ্যমের উপর জোর দিয়ে বলেন, “মিডিয়া যে রোল প্লে করছে এখন, তাতে পর্যবেক্ষকদের উপর নির্ভর করার দরকার নাই। নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই তো সরাসরি টেলিভিশনে দেখতে পাচ্ছেন। সুতরাং মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। মিডিয়ার প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করা দরকার। মিডিয়া যেন ওপেনলি রিপোর্ট করতে পারে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
“তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কিন্তু আমরা পেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে অ্যাকশনটা কে নিবে? পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে অনেকগুলো বিধিনিষেধ আছে যে, তারা ছবি তুলতে পারবে না। এখন বোধয় মিডিয়াও ছবি তুলতে পারবে না।”
আওয়ামী লীগ মনোনয়নপত্র বিতরণ করছে, অন্যদিকে বিএনপি এখনও সিদ্ধান্তই নেয়নি নির্বাচনে অংশ নেওয়া, না নেওয়ার বিষয়ে, এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কেমন হতে পারে, দেশ কোন দিকে যাবে?
এই প্রশ্নে হাফিজউদ্দিন খান অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, “দেশের মালিক ও নাগরিক হিসেবে আমরা চাইব দেশে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কথিত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে সিটি করপোরেশগুলোর নির্বাচনে। সেখানে মারামারি কাটাকাটি হয়নি ঠিক। কিন্তু কতটুকু সুষ্ঠু হয়েছে সে আমরা সবাই জানি, দেখেছি। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের একটা শর্ত হল নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকতে হবে। কিন্তু যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বা হতে যাচ্ছে, তাতে আমরা যেমনটা চাই তেমনটা হবে কিনা সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।”
বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তোফায়েল আহমেদ বলেন, “বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন পদ্ধতিতে আসতে হবে। তাছাড়া আমরা এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদ নিয়ে চলছি। আমাদের আশপাশের কোনো দেশে সেটা নাই। সবার কিন্তু দুইটা কক্ষ আছে। দুইটা কক্ষ থাকলে যেটা হয় একটা কক্ষে এক ধরনের প্রতিনিধি আসে, আরেকটা কক্ষে একটু অন্য ধরনের প্রতিনিধি আসে। এতে আলোচনা, বিতর্ক, আইন প্রণয়নের গুণগত মানের পরিবর্তন হয়। এগুলো আমাদের চিন্তা ভাবনাতে আসা উচিৎ।”
অনুষ্ঠানে তরুণ ভোটারদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সুজন’র নির্বাহী সদস্য সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
জাতীয় নির্বাচনী অলিম্পিয়াডের আগে সারাদেশের ৩০টি নির্বাচনী আসনে ২৯৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয়। সেসব প্রতিযোগিতায় বিজয়ী মোট ৭৩ জনকে নিয়ে শনিবার অনুষ্ঠিত হয় চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা।
অনুষ্ঠানের শেষভাগে অলিম্পিয়াডে বিজয়ী দশজনের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।