বইপোকাদের স্বর্গরাজ্য ‘কোয়েবো’

না। আমি আসলে কোন পাঠাগারের কথা বলছি না। বলছি একটা বইয়ের স্টল মানে বইয়ের দোকানের কথা। আমার দেখা অন্যসব বই দোকানগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2017, 12:12 PM
Updated : 10 July 2017, 01:20 PM

ইংরেজিতে বলতে গেলে ‘কোয়েবো’ অথবা ‘কিয়েবো’। আর যদি কোরিয়ানে বলি তাহলে হবে ‘খুবো’। আমার প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে একটা। উহু, আমি খুব বইয়ের পোকা না। কিন্তু আমি বই পড়তে, বই কিনতে খুব খুব পছন্দ করি। প্রচুর গল্প শুনি আমি আর আমার মেয়ে। আর যখন কোয়েবোতে আসি তখন আসলে বই কেনার লোভটা সামলানো আমার জন্য অনেক কঠিন। আমি না কিনলেও মেয়ের জন্য একটা হলেও বই কিনে নেই আমরা।

দক্ষিণ কোরিয়া আসার কিছুদিন পরই বুঝতে পেরেছিলাম যে এইখানে ইংরেজি অথবা অন্য ভাষার বই পাওয়া খুব কষ্টকর হবে। অনেক খুঁজেছি কিন্তু নিজের পছন্দ অনুযায়ী কোন বইয়ের দোকান পাচ্ছিলাম না। অনেকের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে পেয়ে গিয়েছি এই বই শপটা। প্রথম যেদিন পেলাম ওইদিন আমি এতো খুশি হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম যাক সময় কাটানোর একটা মনমতো জায়গা পেলাম।

আর ভেতরে গিয়ে ঠিকই বুঝতে পারলাম, বইয়ের পোকারা পুরো বিশ্বজুড়েই আছে। ভেতরের পরিবেশ দেখলে যে কারো পড়তে ইচ্ছা করবে। বিশাল একটা শপিং-মলের ভেতরে ২/৩টা স্টোর নিয়ে সাজানো পুরো দোকানটা। অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। খুব ছিমছাম পরিবেশ। যেমনটা একটা পাঠাগারের ভেতর দেখে থাকি আমরা। শান্ত একটা পরিবেশ। আপনি যদি পড়তে নাও ভালবাসেন তবু আপনার মনে হবে এই শপটা একটু ঘুরে দেখি।

কোয়েবোটা আমার কাছে মনে হয় একটা পাঠাগারের মতো। পাঠাগার থেকে আপনি বই কিনতে পারছেন না, কিন্তু এখান থেকে আপনি বই কিনতে পারছেন। এছাড়া সব রকমের সুবিধাতো পাচ্ছেনই।

এটা আসলে একটা চেইন বুক শপ। পুরো কোরিয়াতে ওদের দশটা শপ আছে। মেইন ব্রাঞ্চটা সৌলের গংহুয়ামুনে অবস্থিত। এই মেইন ব্রাঞ্চটাই কোরিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় বুক শপ। ছেলে-মেয়েরা সময় পেলেই চলে আসে বই পড়তে এখানে। মোটামুটি সবগুলো শপের সাজানো গোছানো একই রকম। সবগুলো বইয়ের সেকশন আলাদা আলাদা। সব সেকশনেই আছে বসে বই পড়ার ব্যবস্থা। মানে আপনি এখানে বসেই বই পড়তে পারবেন।

শপের প্রবেশ পথেই রয়েছে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের কালেকশন। সাথে অ্যাওয়ার্ড পাওয়া বইগুলো। আর উপরে বোর্ডগুলোতে প্রত্যেকটা বিষয়ের নাম দেওয়া আছে আপনি সেকশন দেখলেই বুঝতে পারবেন যে কোথায় কোন বই রয়েছে। আর আপনি যদি আপনার পছন্দমতো বই খুঁজে নাও পান সেক্ষেত্রে আপনি কম্পিউটারের সাহায্য নিতে পারেন।

কীভাবে? তাইতো? হুম, এখানে একটু পর পরই আপনি কম্পিউটার পেয়ে যাবেন। সেখানে ওদের নিজস্ব অ্যাপস আছে। ওইখানে সার্চ অপশনে গিয়ে বইয়ের নাম লিখে সার্চ দিলেই আপনি পেয়ে যাবেন ওই বইটা কোন সেকশনে আছে, সঠিক জায়গা এবং সাথে দাম। আপনাকে ঘুরে ঘুরে সময় নষ্ট করতে হবে না।

এখানে আসলে আমার মনে হয় সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারবো। সবাই আসলে সময় নিয়েই আসে। বই যদি কিনতে নাও চান তাতে অসুবিধা নেই। ওই যে বললাম এখানে বসেই আপনি বই পড়তে পারবেন। এই বিষয়টা অসাধারণ লাগে আমার কাছে। এছাড়া ইভেন্ট হলের ব্যবস্থাটাও আমার খুব ভাল লাগে। যে কোন নতুন বই প্রকাশিত হলে প্রথমে এখানে দিয়ে থাকে এবং মাঝে মাঝে বইয়ের লেখকও আসে। এতে করে লেখক ও পাঠকের সম্পর্ক বেশ ভাল হয় এবং লেখকও পাঠকদের তার বই বা উপন্যাস সম্পর্কে ভাল করে বিশ্লেষণ করতে পারে। কোরিয়ান, আন্তর্জাতিক সব ধরণের বই ছাড়া এখানে সিডি, ডিভিডি কেনার জন্য আলাদা সেকশন আছে।

আমারতো মনে হয় মাঝে মাঝেই চলে যাই কোয়েবোতে। সারাদিন যে কীভাবে যাবে বুঝতেও পারবো না। এরকম শান্ত পরিবেশের মজাই আলাদা। যেদিকে তাকাবেন সবাই বই নিয়ে ব্যস্ত, বই পড়তে ব্যস্ত, বই খুঁজতে ব্যস্ত। যারা বই পড়তে পছন্দ করেন, বই ভালবাসেন তাদের এই জায়গাটা পছন্দ হবেই। তবে অবশ্যই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে আপনাকে। খুব জোরে কথা বলা যাবে না, ছবি তোলা যাবে না, আর যদি তুলতেই চান তাহলে আপনাকে অনুমতি নিয়ে ছবি তুলতে হবে।

বই পড়তে যাবেন? অনেক সময়ের ব্যাপার। ক্ষুধা তো লাগবেই। হ্যাঁ, আপনি এখানে খেতে পারবেন। ওদের নিজস্ব কফিশপ থেকে কিনে এইখানে বসে বই পড়তে পড়তে আপনি খেতে পারবেন। বুকশপের ভেতরেই রয়েছে কফিশপ। সেক্ষেত্রে খাওয়ার জন্য অন্য কোথাও যেতে হচ্ছে না। আর কফিশপের মধ্যে রয়েছে বিশাল বড় এক টেবিল, আর ছোট ছোট টেবিল-চেয়ার। টেবিলের দুইপাশ দিয়েই সবাই বসে পড়ালেখা করে। আসলে পরিবেশটা এমনভাবে করা যে আপনার পড়তে ইচ্ছা করবে।

আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা হচ্ছে এই বুকশপ। নিজের জন্য না হলেও মেয়ের জন্য বই কিনতে চলে আসি এখানে। ইংলিশ বই পাওয়াটা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু এখানে আসলে পাওয়া যায়। সেজন্য আরও বেশি বেশি এখানে আসি। অন্যসব বইয়ের দোকানগুলোতে আমি বাচ্চাদের জন্য খুব একটা অপশন দেখিনি। কিন্তু এখানে আপনি বাচ্চাদের জন্য আলাদা একটা পরিবেশ পাবেন। একটু বড় বাচ্চারা এখানে আসে মা-বাবার সাথে। মা-বাবাও বই পড়ে, সাথে বাচ্চারাও। আর ছোট বাচ্চাদের জন্য রয়েছে অ্যাক্টিভিটি এরিয়া। খেলতে পারবে, রঙ করতে পারবে আর বইতো পড়তে পারবেই। অনেক অনেক ভাল লাগে আমাদের এখানে আসলে।
এইতো আজকে আমার পাশেই বসেছে মা আর মেয়ে। দুজনে কি সুন্দর নিজেদের পছন্দমতো বই পড়ছে। আসলে আমার কাছে মনে হয়, বই পড়ার পরিবেশটা আসে পরিবার থেকে। কাউকে জোর করে আপনি বই পড়াতে পারবেন না। বাসায় যদি কারও বই পড়ার অভ্যাস থাকে তাহলে দেখবেন বাচ্চাগুলা বাসার বাইরেও বই পড়তে আগ্রহী হবে।

জ্ঞানার্জনের বা শিক্ষার আসলে কোন বয়স লাগে না। আপনি ইচ্ছা করলে এখন থেকেই বই পড়া শুরু করে দিতে পারেন। যতদিন এখানে থাকবো আমিতো যখনই সময়-সুযোগ করতে পারবো চলে আসবো কোয়েবোতে বই পড়তে, হয়তোবা বই কিনতে।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: shajia.shila@yahoo.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: সাজিয়া শিলা

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!