পড়ুন প্রাণ ভরিয়া কুসংস্কারের কোরিয়া

মনে করুন যে, আপনি মাঝরাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও আপনার মনে হচ্ছে কেউ আপনাকে দেখছে। মানে কেউ আপনার মুখের সামনে এসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আর হাসছে!

সাজিয়া শিলা, দক্ষিণ কোরিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2017, 01:09 PM
Updated : 3 May 2017, 01:09 PM

কেমন যেন অস্বস্তি বাড়ছে আপনার ! এতো গভীর ঘুমের মধ্যেও আপনি খুব ভাল করেই টের পাচ্ছেন অস্বস্তিকর বোধ।

কী করবেন তখন? চোখ মেলে দেখবেন, নাকি ভয়ে চোখ বন্ধ করেই থাকবেন, নাকি মনে করবেন স্বপ্ন দেখছেন? এই অস্বস্তি বোধটা আমার প্রায়ই হয়। মনে হয় ঘুমের মধ্যে কেউ আমাকে দেখছে খুব কাছ থেকে। কেমন ছমছম ব্যাপার, তাই না!

আমার অভিজ্ঞতাটা একটু পরেই বলছি। যদিও আসল বিষয়ের সাথে এর কোনও মিলই নেই। তারপরও ...

প্রবন্ধের নাম দেখেই বুঝতে পারছেন যে, এইবার আমি কী বিষয় নিয়ে লিখতে যাচ্ছি। হ্যা, কোরিয়ানদের মধ্যেও কুসংস্কার খুব বেশি বিদ্যমান। বলবো না সবকিছুতেই, কিন্তু  একটা দুইটা কুসংস্কার এরা খুব বেশি বিশ্বাস করে।

যেগুলো নাকি আমাদের কাছে কিছুই মনে হয় না। অবশ্য আমার কাছে কেন জানি কুসংস্কার মানে অন্ধবিশ্বাসগুলো একটু ভুতুড়ে মনে হয়। আজকে এরকমই কিছু কোরিয়ানদের কুসংস্কারই এ লেখায় তুলে ধরবো। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই শুরু করি।

যখন আমি এইখানে আসি তারপর থেকেই খেয়াল করছিলাম যে এদের সংখ্যায়নে কিছু সমস্যা আছে। কোনও শপিং সেন্টারে লিফটে উঠেছেন, আপনি যাবেন চতুর্থ তলায়, কিন্তু '৪' সংখ্যাটা খুঁজে পাচ্ছেন না।

কী করবেন তখন? প্রথমে মনে করেছিলাম হয়তো আমিই ভুল করছি। হতেই পারে। ভুল করাটাই স্বাভাবিক। মানুষইতো ভুল করে। কিন্তু আমি আসলে ভুল করিনি।

কেমন সেটা বলছি। আসার পর আমি যে বাসায় উঠেছিলাম ওইটা দুইতলা ভবন ছিল। তাই তখন খুব একটা এইসব বিষয়ে খেয়াল করা হয়নি। কিন্তু এরপর যখন বাসা বদল করে চারতলা একটা ভবনে গেলাম তখন ব্যাপারটা নজরে এলো ভালোভাবেই।

সেই ভবনে আমার বাসা ছিল তৃতীয় তলায়। কিন্তু বাসার সংখ্যায়ন ছিল ১, ২, ৩ আর ৫। মাঝ থেকে ৪ নাম্বারটা উধাও।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন!  কারণ কোরিয়ানরা ৪ সংখ্যাটিকে দারুণ অশুভ মনে করে। অধিকাংশ বাসা, বড় বড় বিল্ডিং, শপিং সেন্টার এবংবিশেষ করে হাসপাতালগুলোতে ৪ সংখ্যাটা অনেক কম ব্যবহার করা হয়। কোরিয়ায় শপিং সেন্টার, বড় বড় অফিসের লিফটে ৪ এর জায়গায় আপনি ‘এফ’ লেখা দেখবেন।

আর বাসাগুলোতে ৪ এর বদলে ৫ লিখা হয়। পরে সবার থেকে জানতে পারলাম ওদের ৪ সংখ্যা নিয়ে কুসংস্কারের কথা।

কোরিয়ানরা দিন দিন উন্নত হচ্ছে কিন্তু সাথে করে এই কুসংস্কারটাও বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা ৪ সংখ্যায়নটা খুব বেশি অমঙ্গল মনেকরে।ওদের বেশিরভাগ কুসংস্কারগুলোই এসেছে চাইনিজদের থেকে। কোরিয়ানরা ৪ কে উচ্চারণ করে ‘সা’(사) আর চাইনিজ ভাষায় ’সা’ (死) মানে হচ্ছে ‘মৃত্যু’। যেজন্য ৪ সংখ্যাটাকে খুব অশুভ মনে করা হয়। এইটার আসলে ভিত্তি অথবা সত্যটা কতোটুকু ওইটা ওরাই জানে! তবে এটুকু বলতে পারি যে ওরা এখনও ৪ সংখ্যাটা এড়িয়ে চলে। যেটা আমার কাছে আসলে খুবই অদ্ভূত বিষয় ! এটাকে আমি কুসংস্কার ছাড়া কিছুই মনে করছি না।

এরকম বেশকিছু ভ্রান্ত ধারণা এখনও ওদের মধ্যে বিদ্যমান। তার মধ্যে ফ্যান, রাতে নখকাটা, জুতা উপহার দেয়া, লালকালিতে কারো নাম লেখা ইত্যাদি।

এখানে আরও একটা মজার ব্যাপার কী জানেন- কোরিয়ান বাসাগুলোতে কিন্তু সিলিং ফ্যান এর ব্যবস্থা নেই। ওরা সাধারণ 'স্ট্যান্ড ফ্যান' ব্যবহার করে।

ওদের ধারণা রাতের বেলা কোনও বন্ধ ঘরে যদি কেউ ফ্যান ছেড়ে ঘুমায় তাহলে নাকি তার মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেকে বলেন এইটা আসলে কুসংস্কার না সত্যিই হয়ে থাকে। এমনকি এরকম প্রমাণও নাকি পূর্বে পাওয়া গেছে।

সাধারণ কোরিয়ানরা এটার একটা বিজ্হানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা বলে, যদি কেউ বন্ধ কক্ষে সিলিং ফ্যান ছেড়ে ঘুমায় তাহলে নাকি শরীরের তাপমাত্রা কমে যায় ফ্যান এর বাতাসের কারণে। যার জন্য অক্সিজেন এর অভাব অনুভব হয়ে মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

বৈজ্ঞানিক যুক্তি কী বলে আমি জানি না কিন্তু এইসব আসলে আমার কাছে খুবই হাস্যকর মনে হয়। 

অন্য আরও একটি বহুল প্রচলিত কুসংস্কার হচ্ছে ’লাল কালি দিয়ে কারও নাম লিখলে সেটা তার জন্য দুর্ভাগ্য নিয়ে আসবে'।

কোরিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত  ধারণা হচ্ছে, লালকালিতে কারও নাম লিখলে নাকি তার মৃত্যু চাওয়া হয়। কোরিয়ানরা লাল কালি এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন।

ঠিক এরকমই আরও একটা জিনিস থেকে বিরত থাকা ভালো, সেটা হচ্ছে ‘জুতা’ উপহার দেওয়া। কুসংস্কারটা এমন যে যদি আপনি কাওকে জুতা উপহার দেন তাহলে সে নাকি আপনার থেকে দূরে সরে যাবে।

কেননা আপনি তাকে জুতা উপহার দিয়েছেন। এই কুসংস্কার থেকেই কোরিয়ান প্রেমিক-প্রেমিকারা কেউ কাউকে জুতা উপহার দেয়না এই ভয়ে যে সে যদি ছেড়ে চলে যায়! কী সব হাস্যকর কুসংস্কার, তাই না?

কুসংস্কারটা আমার কাছে মনেহয় অশুভ কিছু ভেবে ভয় পাওয়া। এটা ভেবে যে, যদি এইটা করি তাহলে যদি ওইটা হয় টাইপ। এগুলো চলে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকেই, এখনও চলছে।

আমাদের সবার মধ্যেই হয়তো কিছু কিছু কুসংস্কার লুকিয়ে আছে। যেমন আমি যেটা ঘুমের মধ্যে অনুভব করেছিলাম। ওইটা কোন কুসংস্কার না কিন্তু আমার কাছে প্রথম একটু ভয় লেগেছিল।ঐযে বললাম প্রথমে ছোট্ট করে। কিন্তু এইটা আসলে আমার কাছে এখন অস্বস্তি লাগে। ঘুমের মধ্যে যদি বুঝতে পারি কেউ তাকিয়ে আছে তাহলে অস্বস্তি হওয়ারই কথা।

আমার ৩ বছর বয়সের মেয়েটা এই কাজটা আমার সাথে প্রায়ই করে থাকে। মাঝরাতে যদি তার ঘুম ভেঙ্গে যায় তাহলেই সে ঠিক আমার মুখের সামনে এসে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে। কেমন ভুতুড়ে একটা ব্যপার,তাই না?

ওও... একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম তা হলো, কোরিয়ানরা কিন্তু সত্যিই এইসব খুব বিশ্বাস করে। আর এইসব বিশ্বাস করে দেখেই ওদের এইসব কুসংস্কার নিয়ে ওরা অনেক মুভিও বানিয়েছে। ইচ্ছা হলে আপনিও দেখতে পারেন।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: Shajia.shila@yahoo.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: মাহবুবুল আলম শোয়েব

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!