প্রবাসীর ভ্রমণ: তিমি ভাবে জলে যাই

কয়েকদিন আগে হয়ে গেলো ‘জাংসেংপো হোয়েল ফেস্টিভাল’ মানে তিমি দেখার উৎসব। এ শহরেই আছি বলে ফেস্টিভাল মিস করা যাবে না ভেবে রোজা রেখেই চলে গিয়েছিলাম তিমি উৎসবে।

সাজিয়া শিলা, দক্ষিণ কোরিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2017, 10:55 AM
Updated : 16 June 2017, 11:17 AM

আসল উদ্দেশ্য ছিল আমার তিন বছর বয়সী মেয়েকে ডলফিন শো দেখাবো। আমাদের থেকে সে বেশি উৎসাহী ছিল- ‘আমরা ডলফিন শো দেখতে যাবো, আমরা ডলফিন শো দেখতে যাবো’ বলে মাথা নষ্ট করে দিচ্ছিল। তাই আর দেরি না করে ফেস্টিভালে চলে গিয়েছিলাম।

ফেস্টিভালে সবচেয়ে দুরূহ ব্যাপার হচ্ছে পার্কিং। আপনি যতো তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে যান তার থেকে বেশি সময় লাগে পার্কিং খুঁজতে। যা হোক, খুব কষ্টে ত্রিশ মিনিট খুঁজাখুঁজির পর একটা জায়গায় গাড়ি পার্ক করে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার দু’পাশ ঘিরে রয়েছে অসংখ্য স্টল। ফেস্টিভাল আয়োজন করা হয়েছে হোয়েল মিউজিয়ামে। আসল জায়গায় যেতে যেতে দু’পাশের স্টল গুলো দেখে ফেললাম।

পোর্ট এরিয়া হওয়ার কারণে মিউজিয়াম সাগরের তীর ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে। বেশ সুন্দর লাগছিল দেখতে। আপনি যেন একদম পানি ছুঁয়ে নিতে পারবেন! সেখানে দেখলাম ‘হোয়েল ওয়াচিং ট্যুর’ নামে একটা বড় শিপ রয়েছে। ওটাতে করে মানুষ সাগরের মধ্যে তিমি দেখতে যায়। আমরা ওদিন সাগরে তিমি দেখতে যাইনি, কিন্তু ইচ্ছা আছে কোরিয়া থাকতে থাকতে একবার যাবো সাগরে তিমি দেখতে। কেননা, হোয়েল মিউজিয়াম পুরো কোরিয়াতে এই একটাই। এখান থেকে হোয়েল ওয়াচিং ট্যুরে যাওয়া যায়। 

পুরো মিউজিয়াম ঘিরে স্টল বসানো হয়েছে। বিভিন্ন দেশের খাবারের স্টল, কোরিয়ান ঐতিহ্যের স্টল, বাচ্চাদের মাছ নিয়ে খেলার স্টল, কিছু কাপড়ের স্টল, সাথে বাচ্চা-বড়োদের চুলের ব্যান্ডের স্টল ইত্যাদি। বাচ্চাদের খেলনার স্টলও ছিল। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছিল রেড ইন্ডিয়ানদের ঐতিহ্যবাহী মিউজিকাল শো। অসম্ভব সুন্দর লাগে আমার কাছে।

পুরো জায়গাটা এতো বড়ো যে ওরা তিনটা বড় বড় স্টেজ করেছে অনুষ্ঠানের জন্য। একটাতে দেখলাম গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। একটাতে বাচ্চাদের দিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে আর মেইন যে স্টেজ ছিল সেখানে গীতি নৃত্য-নাট্য হচ্ছিলো। ওটা শেষ হলেই দেখলাম ড্যান্স পারফর্ম। চমৎকার অনুষ্ঠান ছিল ওটা।

এখানে আমরা তিনটা আলাদা আলাদা মিউজিয়াম দেখার জন্য টিকেট কেটেছিলাম। চিন্তা করলাম মেয়েকে আগে ডলফিন শো দেখাবো, তারপর যাবো কোরিয়ান যুদ্ধ জাহাজের ভেতরটা দেখতে এবং অবশেষে দেখবো হোয়েল হিস্টরি মিউজিয়াম।

কথা মতো চলে গেলাম ডলফিন বা শুশুকের শো দেখতে। এর মধ্যে একটু বলি, খুব ছোট থাকতে যখন গ্রামে দাদার বাড়ি যেতাম তখন ছোট্ট একটা নদী পার হয়ে যেতে হতো। তখন বেশ পানি ছিল নদীটাতে। সে অনেক আগের কথা, ওই সময়ে কোন ব্রিজ ছিল না পারাপারের জন্য। ছোট ছোট নৌকাতে পার হতে হতো। মাঝে মাঝে নদী পার হওয়ার সময় দেখা যেতো ছোট ছোট ডলফিন টাইপের কিছু। খুব কালো ও সাইজে বেশ ছোট।

খুব একটা মনে নেই, যতটা মনে হয় সবাই এগুলোকে সম্ভবত ‘শিশু’ অথবা ‘শুশুক’ নামে ডাকতো। এখন আর সেই নদীতে এতো পানি নেই, আর এসব এখন আর দেখা যায় না। কিন্তু ওগুলো যে আসলে শুশুক মানে ডলফিন ছিল না তা এখন খুব ভাল করে বুঝেছি।

যা হোক, চলে যাই ‘হোয়েল লাইফ এক্সপেরিয়েন্স মিউজিয়াম’ মানে ডলফিনের খেলা দেখতে। মেয়েতো এতদিন ইউটিউবে ডলফিন দেখেছে! ওইদিন সত্যি সত্যি ডলফিন আর অ্যাকুয়ারিয়ামে ডলফিনের খেলা দেখে সে তো মহাখুশি। আসলে এ মিউজিয়ামটা বাচ্চাদের জন্য একদম ঠিক আছে। আর ওইদিন পর্যটক হিসেবে বাচ্চারাই বেশি ছিল। ১০-১৫ মিনিট করে একটা শো হয় ডলফিন নিয়ে।

এছাড়া এখানে আপনি ছোট ছোট অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখা বিভিন্ন মাছও বাচ্চাদের দেখাতে পারবেন। ডলফিন অ্যাকুয়ারিয়ামে ঢুকতে মাথাপিছু ৬-৮ ডলার করে রাখবে। সাথে ফোর-ডি দেখার ব্যবস্থা আছে। তিন ডলার করে ফোর-ডিতে দশ মিনিটের একটা অ্যানিমেশন মুভি দেখা যায়। ডলফিন শো আর অ্যাকুয়ারিয়াম দেখা শেষ করে গেলাম কোরিয়ান যুদ্ধ জাহাজ দেখতে।

এতো সুন্দর করে সংরক্ষিত করে রেখেছে যে দেখলে মনে হবে একদম নতুন জাহাজ। এতো বড় জাহাজে আগে কখনও আমার উঠা হয়নি। আমাদের জন্য যুদ্ধ জাহাজ ঘুরে দেখা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। জাহাজের উপরে উঠলে খুব সুন্দর সাগর দেখা যায়। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল, সাথে ইফতারের সময়ও হচ্ছিল। তাই একটু তাড়াতাড়ি জাহাজটা ঘুরে নেমে গিয়েছিলাম হোয়েল সম্পর্কে জানতে।

চলে গেলাম হোয়েল মিউজিয়ামে। সব ধরনের হোয়েলের ইতিহাস লেখা আছে, সাথে হোয়েলের অবয়ব। খুব দক্ষতার সাথে সবগুলো সাজানো রয়েছে। কোন কিছুতে স্পর্শ ও ছবি তোলাতে নিষেধাজ্ঞা আছে। এছাড়া থ্রিডিতে স্ক্রিনিং-এর মাধ্যমে তিমি সম্পর্কে বর্ণনাও দেওয়া হয় যাতে তিমি সম্পর্কে আপনার সঠিক ধারনা হয়।

কোরিয়াতে আসার পর আমি মনে হয় একটা মাসও ফেস্টিভালে যাওয়া ছাড়া থাকিনি। ওরা এতো ফেস্টিভালের আয়োজন করে যে কোন সাপ্তাহিক ছুটিতে আপনাকে ঘরে বসে অলস সময় কাটাতে হবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোরিয়ানরাও এসব ফেস্টিভালগুলো খুব উপভোগ করে ও অংশ নেয়। এ রকম যদি আমাদের দেশেও প্রতিটা ঋতুতে নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে বেশ হতো।

ফিরে আসি তিমি প্রসঙ্গে, হোয়েল মিউজিয়াম সরকারি ছুটির দিনগুলো ছাড়া প্রতিদিন খোলা থাকে। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বিকেল ছয়টা পর্যন্ত। আর এতোকিছু দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে প্রায় ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছিল, তাই বাসায় ফেরার পালা।

মেয়েটা গাড়িতে উঠে আবার শুরু করেছে- ‘আমরা আবার ডলফিন শো দেখতে যাবো’। সে এখনও ভুলেনি ডলফিন শো এর কথা। মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি আবার নিয়ে যেতে হবে ওকে ডলফিনের খেলা দেখাতে। সুকুমার রায়ের ‘খিচুড়ি’ ছড়াটা মনে পড়লো- গরু বলে, “আমারেও ধরিল কি ও রোগে?/মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?”/হাতিমির দশা দেখ–তিমি ভাবে জলে যাই/
হাতি বলে, “এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই৷”

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: shajia.shila@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!