কোরিয়ার গ’জে দ্বীপে পাহাড় ও সাগরের সাথে

সাগর এবং পাহাড় কার না ভাল লাগে! অনেকদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল গ’জে দ্বীপ যাওয়ার। কিন্তু সবদিক থেকে হয়ে উঠছিলো না। সবার মুখে এতো শুনেছি গ’জে দ্বীপের কথা যে এইবার আর না গিয়ে পারলাম না।

সাজিয়া শিলা, দক্ষিণ কোরিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2017, 01:24 PM
Updated : 26 May 2017, 05:09 PM

আসলে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনাগুলো খুব হুট করেই করতে হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। যাওয়ার আগেই হোটেল বুকিং দিতে হয়, না হয় গিয়ে হোটেল খোঁজা আরও একটা ঝামেলার কাজ।

সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে হোটেল ভাড়া একটু বেশি থাকে। আর কোরিয়ায় সাপ্তাহিক ছুটিরদিন ছাড়া বেড়াতে বের হওয়া কঠিন।

এমন এক ছুটির দিনেই রওনা হয়ে গেলাম সকাল সকাল গ’জে দ্বীপের উদ্দেশ্যে। বেরোনোর আগেই কোথায় কোথায় ঘুরবো তার একটা তালিকা করে ফেলেছিলাম । পরিকল্পনা করা হলো- হোটেলে ওঠার আগেই একটা জায়গায় ঘুরে নিবো। 

আমাদের-মানে আমি, আমার কন্যা পুঁই আর বর শোয়েবের- যেতে সময় লাগবে খুব বেশি হলে দুইঘণ্টা। এখানকার হাইওয়েতে গাড়ি চালানো খুব সহজ এবং বেশ নিরাপদও।

গ’জে দ্বীপে যাওয়ার পথে সব চেয়ে আকর্ষণীয় এবং কৌতুহলের ব্যাপার হলো দ্বীপে যাওয়ার পথটা।

সেখানে আপনাকে কোনও ক্রুজশিপ অথবা ফেরি দিয়ে যেতে হবে না। কারণ হচ্ছে, ‘আন্ডার সি টানেল’। ওরা সাগরের ভেতর দিয়ে টানেল করেছে। অসম্ভব রকমের একটা উত্তেজনা কাজ করে টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময়। বুঝতেই পারবেনা কেউ যে সাগরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে!

টানেল থেকে বের হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় প্রকৃতির সৌন্দর্য্য। চারিদিকে সমুদ্র তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ। যেমনটা আমরা সিনেমাতে দেখে থাকি। ঠিক তেমনটি!   

আঁকাবাঁকা পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছুটে চলা আর সাগরের অপরূপ বিশালতা .. উফফ সে যেন এক অফুরন্ত সৌন্দর্য্য।

পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা ঘনসবুজ গাছগুলো যেন আরও পরিপূর্ণ করে তুলেছে সাগরের বিশালতাকে। চোখ জুড়ানো পরিবেশ উপভোগ করতে করতেই কখন যে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি !

কোরিয়া আসার পর থেকেই আমি খুব জলপ্রপাত খুঁজেছি দেখার জন্য। ভী-ষ-ণ ভালোলাগে আমার জলপ্রপাত।

এইবার পেয়ে গেলাম গ’জে দ্বীপের প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। নাম- ‘মুন্দং’। গাড়ি পার্ক করেই হাঁটা দিলাম জলপ্রপাত দেখতে।

পাহাড়টা বেশ উঁচু কিন্তু বেশিক্ষণ হাঁটতে হয় না। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্য স্থানে। যতখানি আগ্রহে কিছুটা ভাটা পড়লো জলপ্রপাতের পানি কম থাকায়। অবশ্য একেবারে কমও নয়। 

জলপ্রপাতে যতো পানি ততো শান্তি। জুলাই- আগস্ট মাসে পানির প্রবাহ সবচেয়ে বেশি থাকে। তখন মনে হয়েছিলো আরও কিছুদিন পরে আসলে হয়ত বেশি উপভোগ করতে পারতাম। তবে চারদিকের পাহাড়, লেক, পাখিদের গান সবমিলিয়ে খুব খারাপও লাগেনি।

তারপর হোটেল ‘চেক ইন’ দিয়েই আবার বের হয়ে গিয়েছি। আমাদের হোটেল থেকে ২ মিনিট হাঁটলেই গ’জের বিখ্যাত সৈকত। ‘হাকদং ব্ল্যাক পার্ল পাবেল বিচ’ মানে কালো নুড়ি পাথরের সৈকত। আমার সবচেয়ে প্রিয় সৈকতগুলোর মধ্যে একটা।

ময়লা নেই, পানির রঙ অসম্ভব সুন্দর, আর সবচেয়ে মজা হচ্ছে বালি নেই। আমার খুব ভালো লেগেছে। অবকাশ যাপনের জন্য একদম সঠিক জায়গা এইটা।

সময় যে কোনওদিক দিয়ে চলে যায় বোঝাই যায় না। সাগরে ঢেউ বেশি না তারপরও ভালো লাগবে। এখানে একটা কথা বলে নেই সেটা হচ্ছে, মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ওরা সাগরের পানিতে একটা করে নিরাপত্তা সীমা টেনে দিয়েছে সবগুলো সৈকতে। এছাড়া নিরাপত্তাকর্মীরা তো ২৪ ঘণ্টা রয়েছেনই। সবকিছু মিলিয়ে সাগর দর্শন অনেক নিরাপদ এখানে। 

এরপরদিন খুব সকালেই বের হয়ে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, আজ যতোখানি পারি অনেকগুলো স্পট দেখবো। দিনটা শুরু করেছিলাম আরও একটা ছোট্ট দ্বীপ দর্শন দিয়ে। তো দ্বীপে যেতে হলে অবশ্যই ফেরি করে যেতে হবে! আমরা যাবো ‘ওয়েদো দ্বীপ’।

ওদের ফেরি সার্ভিসটা খুব সকাল থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। ফেরির টিকেট কেনার সময় একটা কাগজ পূরণ করতে হয়। যেটাতে নাম -ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর  ইত্যাদি দিতে হয়।মোটামুটি একটা তথ্য ফরম পূরণ করতে হয়। পুরোটাই  নিরাপত্তার জন্য।

আমাদের খুব ভাল লাগলো যে- ওরা মানুষের নিরাপত্তার কথা এতো চিন্তা করে!

যাহোক, রাউন্ড টিকেটে প্রতিজন মাথাপিছু ২৭ ডলার। আর ৩ বছরের নিচে বাচ্চাদের কোনও টিকেট লাগবে না। আর দ্বীপে পৌঁছানোর পর দেড়ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া থাকে ঘোরার জন্য।

আমি আসলে পানি খুব ভয় পাই তারমধ্যে বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছি। সত্যি বলতে আমার বেশ ভয় কাজ করছিলো। এছাড়া দ্বীপে যাওয়ার পথে যে দুটো ছোটো ছোটো দ্বীপ পড়বে ওইগুলো পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে।

এতো সুন্দর লেগেছিলো আমার কাছে যে তখন পানি ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা একদমই ভুলে গিয়েছিলাম!

অদেয়ো দ্বীপে পৌঁছতে প্রায় ২০-২৫ মিনিট সময় লেগেছিল। খুব পরিষ্কার, গুছানো, সবুজে ঘেরা একটা দ্বীপ।  আসলে বোটানিক্যাল বাগানের জন্যই এই দ্বীপ সুপরিচিত। তিন হাজারেরও বেশি গাছ আছে এই পুরো দ্বীপটার ভেতর।

দ্বীপের উঁচু জায়গা থেকে সাগরটাকে দেখতে কি যে ভালো লাগে ! একদিকে পাহাড়ের তীর ধরে গেছে সাগর আর অন্যদিকে সাগর আর আকাশ মিশে গেছে। অদ্ভুত এক মেলবন্ধন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের।

সূর্যাস্তটা দেখতে নাকি অপরূপ সুন্দর। আর এতো অল্প সময়ের মধ্যে পুরো দ্বীপটা দেখে শেষ করা বেশ কষ্টকর ছিল আমাদের জন্য।

ওয়েদো দ্বীপ থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়েই এবার চলে গিয়েছি ‘উইন্ডি হিল’ থেকে সাগর দেখতে। ‘উইন্ডি হিল’টা ফেরিঘাটের পাশেই কিন্তু পাহাড়ের উপর উঠতে হয়েছে সিঁড়ি বেঁয়ে। নাম ‘উইন্ডি হিল’ কারণ- সবসময় প্রচণ্ড বাতাস থাকে এই পাহাড়ের উপর। একদম উড়িয়ে নেওয়ার মতো বাতাস।

পাহাড়ের ওপর থেকে সাগরের বিশালতা,বাতাস,পাহাড়ের ঘন সবুজ গাছ, ঠাণ্ডা একটা পরিবেশ- সবার খুব ভাল লাগবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদেরও অনেক ভালো লেগেছে। লোক সমাগমও ছিল প্রচুর। সবমিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের একটা পরিপূর্ণ জায়গা হচ্ছে ‘উইন্ডি হিল’।

এছাড়া ‘হিস্টোরিক পার্ক’, গ’জে জাদুঘর,ক্যানোলা ফুলের বাগান...আরও অনেক জায়গা আছে দেখার।

ঘুরতে ভালোবাসা, ভাললাগা থেকেই আমাদের নতুন নতুন জায়গা ঘুরে বেড়ানো। ব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি পাওয়া আমাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছে। সবকিছু মিলিয়েও অনেক সময় হয়ে উঠে না কোথাও বেড়াতে যাওয়া।

তারপরও নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য একটু সময় বের করে যদি নতুন কোথাও ঘুরতে যাওয়া যায় তাহলে মন্দ কি ! আমরা সময়, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে যাই ঘুরতে।

একটা পরিবর্তন আসে একঘেঁয়েমি জীবন থেকে।

কোথাও একবার পড়েছিলাম, যদি জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে চাও তাহলে ঘুরে বেড়াও। আমি এই কথাটায় বিশ্বাস করি। ভ্রমণে কোনো ক্ষতি নেই।তাতে শুধু জ্ঞানই বাড়বে না বরং অভিজ্ঞতাও হবে প্রচুর। 

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: Shajia.shila@yahoo.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: মাহবুবুল আলম শোয়েব

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!