কোরিয়ানরা নিজেদের জীবনে আমেরিকানদের খুব অনুসরণ করলেও নিজেদের ভাষার প্রতি ওরা খুব কট্টর। আমাদের খুব ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
আসার পর-ই গেলাম বাজার করতে। গিয়ে আমি বোকার মতো হা করে তাকিয়ে আছি আর হাসছি। কোরিয়ানরা বিদেশি দেখলেই কথা বলতে চায়। আমাকে জিজ্ঞেস করছে- ‘ইরোমি মোয়েয়ো? উরিনারা সারাম ইয়েয়ো?’ মানে হচ্ছে, ‘তোমার নাম কি? তুমি কোন দেশের?’
২০১১ সালের মাঝামাঝি। গিয়েছি একটা মিটিং-এ। একটা ইন্টারভিউ দিতে। আগের রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারিনি, এতো টেনশন হচ্ছিল। বিদেশে আমার প্রথম ইন্টারভিউ। কী জিজ্ঞেস করবে, কেমন করে উত্তর দেব? মানে সব মিলিয়ে আমি খুবই নার্ভাস ছিলাম।
অধ্যাপকের সাথে আমার মিটিং ছিল দুপুরের খাবারের পর। অপেক্ষা করছিলাম অধ্যাপকের রুমের বাইরে। ঠিক দেড়টায় একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, আমি সাজিয়া কিনা? বললাম হ্যাঁ। উনি আমাকে বলল, অধ্যাপক আমাকে ডেকেছেন।
খুবই সাধারণভাবে উনি আমাকে সহজ করে দিয়েছিলেন মিটিংটা। প্রথমে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কীভাবে আসলাম? হাসবেন্ড কী করে? আমার সার্টিফিকেট, পোর্টফলিও এইসব। কিন্তু সব কথাই হচ্ছিল খুব সাধারণভাবে।
ও, বলতে ভুলে গেছি যে আমি যেখানে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছি, ওইটা ছিল ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ফ্যাশান ডিজাইন’। বাংলাদেশ থেকে আমি ফ্যাশান ডিজাইনে ডিগ্রি নিয়েছি। তো আমার ইচ্ছা ছিল, আমি এর উপরই মাস্টার্সটা করবো।
এর মধ্যে আমি আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে গেছি। পরের উত্তরটা আসলো এই ঘটনার কিছুদিন পর। তখনও মহাখুশি এই ভেবে যে এইবার হয়তো সব ভালো হবে, কারণ এইবার রিপ্লাইটা এসেছে ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট থেকে। আমি ইংরেজি থেকেও গ্রাজুয়েশন করছি, তাই ধারণা ছিল- ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে তো আর কোরিয়ান পড়াবে না। সব ইংরেজিতেই হবে।
সেদিন আরও বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। ওই আগের বারের মতো এবারও সব ঠিক আছে। সমস্যা ওই একটাই- ভাষা। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টেও কোন বই ইংরেজিতে না, সব-ই কোরিয়ানে রূপান্তর করা। মজা না? এত রাগ হয়েছিলাম, আবার অবাকও হয়েছিলাম- ওদের ভাষার প্রতি এতো ভালোবাসা দেখে।
এতো ঝামেলার পর সবাই বলল, ভাষাটা শেখার জন্য। তো ভর্তি হলাম ভাষা শিখতে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এতো সুন্দর পরিবেশ, এতো অমায়িক তাদের ব্যবহার। সবচেয়ে সেরা হচ্ছে, এইখানে সবাই ইংরেজি বলতে পারে। ওইদিন মনে হয়েছিল হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সপ্তাহে ৩ দিন ক্লাস করতাম আমরা। ওইখানে গিয়ে অনেক নতুন মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছিল। কানাডিয়ান, আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, আমেরিকান আরও অনেক দেশের মানুষদের সাথে একসাথে ক্লাস করেছি। অনেক মজায় আর সুন্দর সময় কেটেছিল তখন। এমনকি আমাদের ক্লাস শিক্ষিকাও আমাদের সাথে আড্ডা দিতেন। একসাথে ক্লাস শেষে অনেকদিন আমাদের সাথে বসে স্টারবাক্সে বসে কফি খেয়েছেন।
তবে এখনও অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। একটা বই কিনবো, ম্যগাজিন কিনবো? খুব কষ্ট করতে হয়। এমনকি এখন আমার মেয়ের জন্য যদি গল্পের বইও কিনতে যাই, তাহলে আরও অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়।
হ্যা, ওদের খুব ভাল ভাল বই স্টল আছে। ওইখানে ইংরেজি সেকশন আছে, কিন্তু মনমতো সব খুঁজে পাওয়া সে এক দুরূহ ব্যাপার। এখনতো মাঝে মাঝে আমরা কোরিয়ান লেখা গল্পের বই-ই ওর জন্য কিনে আনি। ওই যে বললাম না, সব কিছুই ওরা নিজের ভাষায় রূপান্তর করে নিয়েছে। এমনকি বাচ্চাদের গল্পের বইগুলাও।
এখন অবশ্য এই প্রজন্মের কোরিয়ান ছেলেমেয়েরা ইংরেজি খুব ভাল বলতে পারে। আসলে জীবনের কোন কিছুই যেমন থেমে থাকে না, ঠিক তেমনি ভাষাটা না জানলেও থেমে থাকবে না এইখানের জীবন। ধীরে ধীরে সবাই-ই নিজের জন্য ভাষাটা শিখে নেন।
তবে ওদের ভাষার প্রতি এতো ভালোবাসা, এতো মর্যাদা দেখে আমার বাংলা ভাষার প্রতি আরও শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে। ওদের গর্ব হচ্ছে ওদের ভাষা, ঠিক যেমন আমার গর্ব আমার- বাংলা ভাষা।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ইমেইল: Shajia.shila@yahoo.com
ছবি কৃতজ্ঞতা: মাহবুবুল আলম শোয়েব
লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |