আমার চোখে সিউল

সিউলে ঘোরাঘুরিটা শুরু হয়েছিলো 'ইউহা উইমেন্স ইউনিভার্সিটি' দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টা বাসার পাশেই হওয়ায় প্রথম ওটাই দেখতে যাই।

সাজিয়া শিলা, দক্ষিণ কোরিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2017, 03:08 AM
Updated : 11 April 2017, 03:08 AM

দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টা ওপরের দিকে। অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর স্থাপত্যটা পুরোই আলাদা। যখন দেখতে গিয়েছিলাম, তখন আগে থেকেই একটা ধারণা নিয়ে গিয়েছিলাম যে কেমন হবে, কী কী আছে আশেপাশে- এইসব আর কি। গিয়ে দেখি, যা ধারণা করে গিয়েছিলাম, তার থেকে বাস্তবে দেখতে অনেক সুন্দর।

মূল ফটক দিয়ে ঢোকার সময়ই সবার নজর কাড়বে চেরি ফুলের স্থাপত্যটি। তারপরই চোখে পড়বে মূল আকর্ষণ- ইউনিভার্সিটি কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্সের স্থাপত্য দেখার জন্যই সবাই আসে। পুরো দুই পাশের বিল্ডিংটার দেয়াল স্বচ্ছ আয়না ( মিরর) দিয়ে করা। দিনের বেলা দেখতে খুব বেশি সুন্দর লেগেছে রাতের বেলা থেকে।

আর একটা আকর্ষণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলো ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে তৈরি করা। যেটা সচরাচর দেখা যায় না। অনেক বেশি সুন্দর লেগেছে আমার কাছে। মেয়েদের ইউনিভার্সিটি হওয়াতে এই ইউনিভার্সিটির পাশ ঘিরেই রয়েছে অনেক কেনাকাটার দোকান, যেজন্য সারাদিনই খুব জমজমাট পরিবেশ বিরাজ করে এলাকাটা ঘিরে। আমার মত যারা অনেক লোকারণ্য পছন্দ করে, তাদের খুব ভাল লাগবে এই জায়গাটা।

তারপর সবার কাছ থেকে জানতে পারলাম যে ‘ইতেওয়ান’ হচ্ছে বিদেশীদের জন্য খুব জমজমাট জায়গা। সব দেশের দূতাবাস ওইখানেই, সাথে আন্তর্জাতিক সব ফেস্টিভালগুলো ইতেওয়ানেই হয়। তখন গিয়েছি ইতেওয়ানে। কিন্তু আমরা যেকোনো একটা ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভালের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কেমন হয় ওইটা দেখার জন্য।

কিছুদিন পর জানতে পারলাম,  ইতেওয়ানে গ্লোবাল ভিলেজ ফেস্টিভাল হবে।  আমরা শুনে তখনই পরিকল্পনা করে ফেলেছিলাম, যাব অবশ্যই। ‘ইতেওয়ান গ্লোবাল ভিলেজ ফেস্তিভাল’ মানে আন্তর্জাতিক মিলন মেলা আমার ভাষায়।

পুরো ইতেওয়ান জুড়ে ছিল বিভিন্ন দেশের খাবারের দোকান, অনেক দেশের ঐতিহ্যগত স্টল, বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যগত পরিবেশনা। সেখানে আমাদের বাংলাদেশের স্টলও ছিল এবং বাংলাদেশি দূতাবাস থেকে বাঙালিদের পরিবেশনাও ছিল। অনেক উপভোগ্য ছিল অনুষ্ঠানটা।

 বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের পরিবেশনা, স্টল- সব মিলিয়ে ওই অনুভবটা সত্যি অনেক বেশি গর্বের ছিল। প্রতি বছর-ই এই ফেস্তিভালটা হয়। সিউল এর কোন বাঙালি মনে হয় এই ফেস্টিভালটা মিস করে না। এই ফেস্টিভালটার জন্য আমরা অনেকদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলাম ঠিকই, কিন্তু এর মাঝেও অনেক ঘুরে বেরিয়েছি।

বেড়ানোর জায়গার নাম জানতে চাইলেই প্রথমে আপনাকে শুনতে হবে  'হান গাং' অথবা 'হান রিভার'-এর নাম। মানে একটা নদীর নাম। নদীটার নাম ই হচ্ছে 'হান'। আর 'গাং' মানে হচ্ছে 'নদী'।  নদীটা সিউল শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

এছাড়া নামসান টাওয়ার, মিয়ংদং, গিয়ংবুকগুং প্যালেস, বুকচং হ্যনক ভিলেজ, নামদেমুন, দংদেমুন, কোয়েক্স অ্যাকোয়ারিয়াম, গাংনাম, লটে ওয়ার্ল্ড অন্যতম। এছাড়া আরও অনেক অনেক দর্শনীয় জায়গা রয়েছে। কিন্তু আমরা ঠিক করেছিলাম যে আগে আমরা কোরিয়ার ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জায়গাগুলো দেখবো। ওই চিন্তা করেই গিয়েছিলাম কোরিয়ান রাজা-রাণীর প্যালেস দেখতে।

 গিয়ংবুকগুং প্যালেস। শহরের এক প্রান্তে এতো সুন্দর গুছানো, পরিষ্কার পাঁচটি প্যালেস একসাথে। কোরিয়ান ঐতিহ্য আর দর্শনার্থীদের জন্য আসলেই এই প্যালেসগুলো খুব সুন্দর করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কোরিয়ানরাও খুব যায় ছুটির দিনে ঘুরতে।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, আপনি ইচ্ছা করলেই কোরিয়ান 'হানবক' মানে ওদের প্রথাগত পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতে পারবেন প্যালেসের ভেতর। এই পোশাকগুলো প্যালেসের পাশের দোকানগুলো থেকে আপনি ভাড়া করে পরতে পারবেন। ব্যাপারটা আমাদের খুব মজার লেগেছে। ঐতিহ্য ধরে রাখাটা আর ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটাই মূল এখানে।

আমাদের অনেকেই বলেছিল যে, যদি এক বছরও সিউল থাকি, তাহলেও নাকি পুরো সিউল ঘুরে শেষ করতে পারবো না। সত্যি-ই তাই! ১ বছর ৩ মাস সিউলে ছিলাম আমরা। কোন ছুটির  একটি দিনও বাদ দেইনি আমরা বেড়ানোর জন্য, তবুও পুরো সিউলের অর্ধেকও ঘুরে শেষ করতে পারিনি। আর এতো জায়গায় ঘুরেছি যে একবারে লিখে শেষ করা যাবে না।

সবার সাথে মিশে, সিউল ঘুরে বেরিয়ে অনেক কিছু দেখেছি, শিখেছি আর সিউল সম্পর্কে অনেক শুনেছি। সবার কাছেই যেন সিউলটা খুব বেশি গুরুত্ব পায়। বুঝতে পেরেছি সিউল ওদের সত্যিকারের প্রাণ।

কোরিয়ানরা সিউল কে 'সৌল' বলে। ঢাকা যেমন আমাদের সবকিছু, আমাদের গন্তব্য, ঠিক তেমনি সৌলকে ঘিরে ওদের সবকিছু,  প্রাণকেন্দ্র। আমার ভাষায় বলতে গেলে- জমজমাট, প্রাণবন্ত ঢাকা শহর আমার কাছে 'সৌল'। এতো ভালো সময় কাটিয়েছি সৌলে, আমি এখনও খুব মিস করি। যেদিকে তাকাবেন, সেদিকেই খুব জমজমাট পরিবেশ।

যারা আমার  মতো লোকারণ্য পছন্দ করেন, তাদের খুব ভালো লাগবে। খুব গোছানো, পরিষ্কার, নিয়মানুগ উপায়ে গড়ে তুলেছে যেন। অবশ্য অনেকের কাছেই সৌল ভালো লাগে না, এত বেশি মানুষ আর ব্যস্ত জীবনের জন্য। কিন্তু হ্যাঁ, অনেক অনেক বেশি ব্যয়বহুল শহর। পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম ব্যয়ের দিক দিয়ে।

অবশ্য এর সাথে কিন্তু সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। যেকোনো সময় আপনি ইচ্ছে হলে একাই বের হতে পারবেন। রাত ২টা-৩টা কোন ব্যাপার না। ব্যয়বহুলের দিক দিয়ে যেমন অন্যতম ঠিক তেমনি নিরাপত্তার দিক দিয়ে আমি বলব- সেরা।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল:  Shajia.shila@yahoo.com

ছবি কৃতজ্ঞতা:  মাহবুবুল আলম শোয়েব

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!