সালমান রুশদি: হুমকির মুখে অন্তরালে, প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে আক্রান্ত

লেখক হিসেবে প্রশংসিত সালমান রুশদি আলোচনায় তার ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 August 2022, 02:46 PM
Updated : 13 August 2022, 02:46 PM

পাঁচ দশকের সাহিত্যিক জীবনে সালমান রুশদির কাছে মৃত্যুর হুমকি অচেনা কিছু নয়। তবে এবার সেই হুমকি আর হুমকি হয়েই থাকেনি, সরাসরি আক্রান্ত করেছে তাকে।

শুক্রবার নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠান মঞ্চে ঘটল এই ঘটনা। এক ব্যক্তি দৌড়ে মঞ্চে উঠে লেখকের ঘাড়ে ও পেটে একাধিকবার ছুরি চালান। ফলাফল, অস্ত্রোপচারের পর রুশদি এখন ভেন্টিলেশনে। অবস্থা তার গুরুতর; কথা বলতে পারছেন না, একটি চোখ হারানোর ঝুঁকিতেও রয়েছেন।

হামলাকারী হিসেবে হাদি মাতার নামে ২৪ বছর বয়সী এক যুবককে আটক করা হয়েছে। ওই যুবক শিয়া উগ্রবাদী এবং ইরানের ক্ষমতাসীন ধর্মীয় গোষ্ঠীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল, এমন ইঙ্গিত পাওয়ার খবর এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে।

তিন দশক আগে এই ইরানেরই তৎকালীন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া দিয়েছিলেন। আর তা আলোচিত উপন্যাস ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এর জন্য।

শুক্রবার রুশদি হামলার শিকার হওয়ার পর বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সালমান রুশদির জীবন, তার সাহিত্যকর্ম, তার প্রভাব এবং হুমকি মোকাবেলা করে তার চলার উপাখ্যান।

Also Read: হামলায় আহত সালমান রুশদি ভেন্টিলেটরে, কথা বলতে পারছেন না

পুরো নাম আহমেদ সালমান রুশদি, জন্ম ১৯৪৭ সালে, ভারত ভাগের ঠিক আগে আগে মুম্বাইতে। স্কুলের লেখাপড়া মুম্বাই ও ইংল্যান্ড ও রাগবি স্কুলে। কেমব্রিজের কিংস কলেজে ইতিহাস নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেন তিনি।

ভারতের একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম হলেও রুশদি নিজেকে একজন নিরীশ্বরবাদী হিসেবেই পরিচয় দেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ঘোর সমর্থক তিনি। তবে গত দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রেই থাকছিলেন তিনি।

লেখালেখির পাশাপাশি একটি বিজ্ঞপনী সংস্থার কপিরাইটারের কাজের অভিজ্ঞতাওিআছে সালমান রুশদির। ছিলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ‘ফুটলাইটস ড্রামাটিক’ ক্লাবের সদস্য, যেখনে কখনও সখনও অভিনয়ও করেছেন। কিছুদিন ধরে সমাজসেবার নানা ধরনের কাজেও নিজেকে জড়িয়েছেন।

রুশদি এখন পর্যন্ত ১২টি উপন্যাস, তিনটি প্রবন্ধ সঙ্কলন প্রকাশ করেছেন, শিশুদের জন তার লেখা দুটি বইও বেরিয়েছে। লিখেছেন আত্মজীবনীও।

বুকার পুরস্কারজয়ী সালমান রুশদি এখন সর্বকালের সেরা ব্রিটিশ লেখকদের একজন হিসেবে স্বীকৃত হলেও তার প্রথম বই ‘গ্রিমাস’ তেমন সাফল্যের ছোঁয়া পায়নি। তবে তখনই কিছু সমালোচক তার মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন।

দ্বিতীয় বই ‘মিডনাইট চিলড্রেনস’ লিখতে রুশদি সময় নিয়েছিলেন দীর্ঘ পাঁচ বছর। ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের ছকে ফেলে জাদু বাস্তবতার মিশেলে লেখা তার সেই উপন্যাসই ম্যান বুকার পুরস্কার জিতে নেয় ১৯৮১ সালে। বইটি পাঁচ কোটি কপি বিক্রি হয় সেসময়ে।

রুশদির তৃতীয় উপন্যাসের পটভূমি এক দুর্লভ ছদ্মবেশী পাকিস্তানিকে নিয়ে, প্রকাশকাল ১৯৮৩। এর চার বছর বাদে তিনি লিখলেন ‘দ্য জাগুয়ার স্মাইল’, নিপাট ভ্রমণ কাহিনী, নিকারগুয়া নিয়ে। এরপরের বছরগুলোয় নানা লেখায় জয়রথ ছুটিয়েছেন এই লেখক। এরমধ্যে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ গোটা বিশ্বেই বিতর্কের ঝড় নামায়।

৭৫ বছর বয়সী রুশদির পরবর্তী উপন্যাস ‘ভিক্টোরি সিটি’ আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে বাজারে আসার কথা রয়েছে।

২০০৭ সালে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ নাইট খেতাবে ভূষিত করেন রুশদিকে। তখন পাকিস্তান ও ইরান এর বিরোধিতা করেছিল। ২০০৮ সালে ‘দ্য টাইম’ ১৯৪৮ সালের পর থেকে যুক্তরাজ্যের সেরা ৫০ জন সাহিত্যিকের তালিকায় ত্রয়োদশ স্থানে রাখেন রুশদিকে।

বিতর্কে মোড়ানো ‘স্যাটানিক ভার্সেস’

‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশ হওয়ার পর ‘ধুন্ধুমার কাণ্ড’ শুরু হয় বিশ্বজুড়ে। সাহিত্যের গুণবিচার ছাপিয়ে ধর্ম বইটিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মানদণ্ড করে দাঁড়িয়েছিল।

বইটি ঘিরে তৈরি হওয়া ক্ষোভ-বিক্ষোভের তীব্র আঁচ পৌঁছে যায় দেশে দেশে। আমেরিকান এবং ইউরোপীয় দেশগুলো বনাম মুসলিম দেশ জড়িয়ে পড়ে কূটনৈতিক জটিলতায়, হয় দাঙ্গা ও রক্তপাতও। বইটি প্রকাশের পর দীর্ঘ এক দশক সালমান রুশদিকে থাকতে হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে।

এই উপন্যাসের কাহিনীতে দুটি নাম নিয়ে আপত্তি ওঠে মুসলমানদের মধ্য থেকে। এছাড়া তিনি বইয়ের যে শিরোনাম নিয়েছেন, তা নিয়েও ওঠে বিতর্ক। মুসলমানরা একে তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে দেখে।

‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’র বিষয়বস্তু নিয়ে বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের মধ্যে ‘ধর্মনিন্দা’ উস্কে দেওয়ার অভিযোগে দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়ে। বেশ কয়েক বছর কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন রাখে যুক্তরাজ্য ও ইরান।

বই প্রকাশের এক বছর পর ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে ব্র্যাডফোর্ডের মুসলমানরা আনুষ্ঠানিকভাবে বইটির একটি কপি পুড়িয়ে দেয় এবং পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে উপমহাদেশে দাঙ্গা হয়, হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তেহরানে ব্রিটিশ দূতাবাসে পাথর নিক্ষেপ হয়।

বিক্ষোভ আর সহিংসতায় ‘দ্য সাটানিক ভার্সেস’ প্রথম প্রথম নিষিদ্ধ করে রুশদির জন্মস্থান ভারত, এরপর তালিকায় নাম লেখায় পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাও। এরপর বইটি নিষিদ্ধের হিড়িক পড়ে মুসলিম দেশগুলোতে।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি ১৯৮৯ সালে রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া দেন। এই লেখকের মাথার দাম ঘোষণা করা হয় ৩০ লাখ ডলার।

সে সময়ে যুক্তরাজ্যের মুসলিম নেতাদের মধ্যেও রুশদিকে নিয়ে বিভেদ দেখা যায়। কিছু নেতা খোমেনিকে সমর্থন জানালেও অনেকেই সমস্যাটির সমধান প্রশ্নে ‘মধ্যপস্থার’ আশ্রয় নিতে আহ্বান জানান।

রুশদিকে হত্যার হুমকির নিন্দা আসে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ থেকে। রুশদিকে সমর্থন জানানোয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় সব সদস্য দেশ থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয় তেহরান।

সে বছরই রুশদিকে হত্যার জন্য লেবাননের একটি ইসলামিক দল বইয়ের ভেতরে বোমা ভরে লন্ডনের এক হোটেলে পাঠায়। তবে বোমাটি আগেভাগে বিস্ফোরিত হওয়ায় হোটেলের দুটি তলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, হামলাকারী নিজেও নিহত হয়।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ ওঠায় রুশদি সে সময়ে তার মনস্তাপও জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে মন গলেনি খোমেনির।

‘স্যাটানিক ভার্সেস’র প্রকাশনা সংস্থা ভাইকিং পেঙ্গুইনের লন্ডন অফিস এবং প্রকাশকদেরও নজরে রাখা হয়। নিউ ইয়র্কে ওই সংস্থাটিতে কর্মরতরাও মৃত্যুর হুমকি পান।

পরবর্তীকালে ইরান সরকার খোমেনির ওই ঘোষণার বিষয়ে আর আগে না বাড়লেও সরকার সমর্থিত একটি ধর্মীয় ফাউন্ডেশন ২০২১ সালে পুরস্কারের ওই অঙ্কের সঙ্গে আরও ৫ লাখ ডলার যোগ করার ঘোষণা দেয়। তার নিয়ে তেহরান সরকার কোনো আপত্তি জানায়নি, অর্থাৎ বহাল থেকেছে মৃত্যু পরোয়ানা।

২০১৫ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় রুশদির উপস্থিতির জন্য তেহরানের সাংস্কৃতিক বইমেলা থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

এসব ঘটনার জেরে আতঙ্কে রুশদিকে সস্ত্রীক আত্মগোপনে থাকতে হয় প্রায় দশ বছর। সে সময় এই লেখককে পুলিশি সুরক্ষা দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।

এক সময়ে বই নিষিদ্ধ করলেও অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসার পর ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশদিকে ভিসা দেয় ভারত সরকার। কিন্তু সে সময় দেশটির মুসলিমরা এর বিরোধিতা করে।

ওই ঘটনার দুদশক পর ভারতের জয়পুরে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি সাহিত্য উৎসবে রুশদির থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেখানেও প্রতিবাদ জানায় কয়েকটি মুসলিম গোষ্ঠী। তাই সেবারে আর ওই উৎসবে যোগ দেওয়া হয়নি এই লেখকের।

হুমকি মাথায় নিয়ে রুশদি নিজে বহু বছর অক্ষত থাকতে পারলেও স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশের সঙ্গে জড়িত সবার ভাগ্যে তা ঘটেনি। বইটির নরওয়েজিয়ান প্রকাশক ৯০ এর দশকের শুরুতে আততায়ীর গুলিতে গুরুতর আহত হন। আর জাপানি ভাষায় বইটির অনুবাদককে ছুরি মেরে হত্যাই করা হয়।

খোমেনির দেওয়া ফতোয়ার বছর ছয়েক পর রুশদি প্রথম জনসমক্ষে আসেন লন্ডনে ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর।

দীর্ঘদিন ব্রিটিশ সরকারের নিরাপত্তায় থাকার পর ২০০০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে বসবাস করতে শুরু করেন রুশদি। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও নেন।

এত ডামাডোলেও আটলান্টিকের দুকূলেই ‘বেস্ট সেলার’ হয় ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। সমালোচক এবং বোদ্ধা মহলে প্রশংসাও পায়, জেতে ‘হুইটব্রেড’ পুরস্কারও।