‘‘আমি স্বীকার করছি.. কনজারভেটিভ পার্টি যা করার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিল, আমি তা করতে পারছি না।’’
Published : 20 Oct 2022, 10:11 PM
জ্বালানি সংকট এবং চরম মূল্যস্ফীতিতে দিশেহারা জনগণের উপর থেকে করের বোঝা সর্বোচ্চ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন লিজ ট্রাস। কিন্তু নিজের সেই প্রতিশ্রুতি তিনি পূরণ করতে পারেননি। বরং দেশকে ঠেলে দিচ্ছিলেন আরো গভীর অর্থনৈতিক সংকটের দিকে।
তবে কী পদত্যাগের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার চরম মূল্য দিতে হলো তাকে? প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় পদত্যাগ করে যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম সময়ের প্রধানমন্ত্রী এখন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী ট্রাসকে ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তার পেছনের কারণ আসলে কী?
২৩ সেপ্টেম্বরের ‘ডিজাস্টার’
গত ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রাস ও তার ওই সময়ে অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্টেং একটি নতুন ‘উন্নয়ন পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেন। এতে ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ কর ছাড়ের পাশাপাশি জাতীয় বিমা পরিকল্পনা ও স্ট্যাম্প শুল্কেও ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়। ব্যাপক সরকারি ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা এই পরিকল্পনা স্থবির অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে বলে প্রথমে তারা আশা প্রকাশ করেন।
কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার উল্টো ঘটনা। পরিকল্পনাটি সরকারের ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। পাউন্ডের মান এবং সরকারি বন্ডের মূল্য দ্রুত কমতে শুরু করে (সেল অফ) এবং ২৬ সেপ্টেম্বর ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দাম ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়। যা আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারকে এমন মাত্রায় ধাক্কা দেয় যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বাজারকে চাঙ্গা করার জন্য ৬৫ বিলিয়ন পাউন্ডের (৭৩ বিলিয়ন ডলার) একটি কর্মসূচী নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।
প্রধানমন্ত্রী ট্রাস বিবিসি টেলিভিশনে তার ওই পরিকল্পনার পক্ষে বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কোয়ার্টেং একটি বিবৃতি প্রকাশ করে এটি কঠিন একটি শীতকালজুড়ে পরিবারগুলোকে সাহায্য করার বিস্তৃত উদ্যোগ থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছিল বলে স্বীকার করে নেন। বলেন, ‘‘ফলে ৪৫ শতাংশ আয়কর হার বিলোপ করার দিকে আমরা আর এগোচ্ছি না।”
১০ দিনের মাথায় নিজেদের ঘোষিত পরিকল্পনা পুরো উল্টে দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত ক্ষমতায় আসার মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যে ট্রাস ও কোয়ার্টেংকে বিশাল চাপে ফেলে।
বাড়তে থাকা রাজনৈতিক চাপ এবং বাজার নিয়ে বেসামাল পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৪ অক্টোবর কোয়ার্টেংকে বরখাস্ত করেন ট্রাস। যিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং মিত্র বলে পরিচিত।
কোয়ার্টেংকে বরখাস্ত করার দিনই ট্রাস ঘোষণা করেন, তার পূর্বসূরি বরিস জনসনের পথ অনুসরণ করে তিনিও ‘কর্পোরেশন ট্যাক্স’ বা কোম্পানি কর ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করবেন। অথচ তিনি তার আগের পরিকল্পনায় এটিকে সর্বোচ্চ ১৯ শতাংশের মধ্যে আটকে দেয়ার কথা বলেছিলেন। তার আগেই তো আয়কর সর্বোচ্চ কমানোর সিদ্ধান্তও উল্টে দেয়া হয়।
দৃশ্যপটে জেরেমি হান্টের আগমন
কোয়ার্টেং বরখাস্ত হওয়ার পর নতুন চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ পান জেরেমি হান্ট। তিনি গত সোমবার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম যে কাজটি করেন তা হলো, তিন সপ্তাহ আগে ঘোষণা করা ট্রাস-কোয়ার্টেংয়ের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রায় পুরোটাই বাতিল করে দেয়া।
জ্বালানির উচ্চমূল্যে নাভিশ্বাস উঠা জনগণকে এ খাতে সহায়তা করতে ট্রাস-কোয়ার্টেং যে বিস্তৃত স্কিম ঘোষণা করেছিলেন হান্ট তাতেও লাগাম টানেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হান্ট এসব সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, যে বাজেট পরিকল্পনার স্বপ্ন দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলে ট্রাস সেটা যদি বাস্তবায়িত না-ই করা যায় তবে তার প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকা কতটা যৌক্তিকতা।
ট্রাস নিজেও তার পদত্যাগের ঘোষণার সময় বলেন, ‘‘আমি স্বীকার করছি.. কনজারভেটিভ পার্টি যা করার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিল, আমি তা করতে পারছি না।’’
দলের ভেতর বিদ্রোহ
দলের ভেতর বিদ্রোহ এবং আস্থাহীনতার কারণেই গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বরিস জনসন। গভীরভাবে বিভক্ত কনজারভেটিভ পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই গত ৬ সেপ্টেম্বর জনসনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন ট্রাস। কিন্তু দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে চরম ব্যর্থ হন তিনি। বরং একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার বিরুদ্ধেই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম সময়ে এমপিদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ এবং তাকে উৎখাতের চেষ্টা করার গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।
আর বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যানের পদত্যাগ ট্রাস সরকারের ভেতরের চরম বিশৃঙ্খলার নগ্ন চিত্র সামনে নিয়ে আসছে।
ব্রাভারম্যান তার পদত্যাগপত্রে সরাসরি ট্রাসের বিরুদ্ধে ক্ষোভও প্রকাশ করেন। দলীয় বেশ কয়েকজন এমপিও খোলাখুলি ট্রাসকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু
৬ সেপ্টেম্বর ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সাত দশকের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর মারা যান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রানির মৃত্যুতে ১০ দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের ঘোষণা করা হয়। ট্রাস সরকারের পথ চলা শুরু হয় ওই ১০ দিনের শোকের মধ্যে।
যে পথে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস
ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস? ঘোষণা আসছে সোমবারই
ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস? ঘোষণা আসছে সোমবারই
প্রধানমন্ত্রী হলে জ্বালানি সংকটে আশু ব্যবস্থা নেব: লিজ ট্রাস
যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চূড়ান্ত লড়াইয়ে ঋষি সুনাক ও লিজ ট্রাস