“আমি জানি না, পাখিটিকে তারা কোন অবস্থায় রেখেছে। তারা অবশ্যই পাখিটিকে আটকে রেখেছে, নাহলে সেটি আমার কাছে উড়ে আসত,” বলছেন মোহাম্মদ আরিফ।
Published : 24 Mar 2023, 04:58 PM
ভারতের উত্তর প্রদেশে সারসের সঙ্গে এক যুবকের বন্ধুত্বের ঘটনা আলোচনায় আসার পর দুর্লভ সেই সারসটিকে জব্দ করে নিয়ে গেছে বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
পাখিটিকে হেফাজতে নিয়ে উত্তর প্রদেশের কর্মকর্তারা অভয়ারণ্যে ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
ছোট একটি মানবিক কাজের মাধ্যমে অবিচল এক বন্ধু সারস পাখিকে পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আরিফ (৩০) নামে উত্তর প্রদেশের এক কৃষক। ওই ঘটনা সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হলে নজরে আসে কর্তৃপক্ষের; এরপর সারসটিকে আর নিজের কাছে রাখতে পারলেন না সেই যুবক।
ঘটনা এক বছর আগের। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমেথির বাড়ি থেকে এক-দেড়শ মিটার দূরে নিজেদের ক্ষেতে গিয়ে আরিফ এক আহত সারসকে পান। সারসটির পা ভেঙে গিয়েছিল, সেখান থেকে রক্ত ঝরছিল।
আরিফ সারসটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে ও যত্ন নিয়ে সারসটিকে সারিয়ে তোলেন। দেড় মাস পর সারসটি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে, নিজের পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে শুরু করে।
সুস্থ হওয়ার পর সারসটি প্রকৃতিতে ফিরে যাবে, আরিফ এমনটিই ভেবেছিলেন। কিন্তু সারটি তাকে ছেড়ে যায়নি, তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতে শুরু করে। এভাবে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণ একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
“দিনের বেলা যখন কাজে চলে যাই, সারসটি আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, অন্যান্য পাখিদের সঙ্গে মেশে। কিন্তু যখন সন্ধ্যায় আমি ফিরে আসি সারসটি আমার কাছে চলে আসে, আমাকে আলিঙ্গন করে আর আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাই,” বলেছিলেন আরিফ।
বিবিসি জানিয়েছে, পাখিটিকে অভয়ারণ্যে নেওয়ার পরই নতুন ঠিকানা ছেড়ে সেটি উড়ে চলে গেছে বলে জানা গেছে। তবে অভয়ারণ্য কর্তৃপক্ষ সেটি অস্বীকার করেছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, সারসটিকে কিছু গ্রামবাসী খুঁজে পায় এবং তারা সেটিকে খাওয়াচ্ছেন এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করে বলছে, পাখিটি যে সামাসপুর অভয়ারণ্যে নেওয়া হয়েছিল, তার সীমানার মধ্যেই ছিল।
বন কর্মকর্তা রুপেশ শ্রীবাস্তব বিবিসি হিন্দিকে বলেন, পাখিটি কোনো রুমে আটকা ছিল না। এটি নিজেই তার খাবার খুঁজছিল এবং আমরাও তাকে গম, রুটি ও পানি দিচ্ছিলাম।
‘তার চলাফেরায় তো বাধা দিইনি’
উত্তর প্রদেশের জাতীয় পাখি হল সারস। সেখানে অন্তত ১৭ হাজার সারস রয়েছে। ভারতীয় আইন অনুযায়ী কেউ সারস পুষলে, এমনকি খেতে দিলেও সেটি বেআইনি।
সারসের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়া আরিফ বলেন, মঙ্গলবার বিকালে কর্মকর্তারা তার বাড়িতে এসে জানায়, পাখিটি আর তার সঙ্গে থাকতে পারবে না। বন্যপ্রাণী বিভাগের কাছ থেকে তারা পাখিটিকে জব্দ করার আদেশ পেয়েছে।
“আমি একজন কৃষক। আমি বন্যপ্রাণী আইন জানি না। কিন্তু আমি যদি তাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখতাম, বেঁধে রাখতাম এবং কোথাও যেতে দিতাম না, তাহলে বুঝতাম বন বিভাগ কেন সেটি আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে চায়।
“কিন্তু আপনারা দেখেছেন, এটি উড়ে বেড়াত এবং চলে আসত। যেখানে খুশি চলে যেত। আপনারা কী কখনও দেখেছেন, আমি তার চলাফেরায় বাধা দিয়েছি?”
গত মাসের শুরুতে সারস পাখিটি কীভাবে সেরে উঠল এবং সুস্থ হওয়ার পর সেটি উড়ে চলে না গিয়ে মানুষের কাছেই থেকে গেল, বিবিসি হিন্দিকে সেই ব্যাখ্যা করেছিলেন আরিফ।
“কিছুদিন এটি উড়ে চলে যাচ্ছিল, তবে সূর্যাস্তের আগেই আবার ফিরেও আসত।”
মঙ্গলবার যখন পাখিটি নিয়ে কর্তৃপক্ষ সামাসপুর অভয়ারণ্যের দিকে চলে যাচ্ছিল, সেসময় তাদের গাড়ির পিছু নিয়েছিলেন আরিফ।
“কিন্তু তারা আমাকে তাড়িয়ে দেয়। আমি জানি না, তারা পাখিটিকে কোন অবস্থায় রেখেছে। তারা অবশ্যই পাখিটিকে আটকে রেখেছে, না হলে সেটি আমার কাছে উড়ে আসত। আমি চাই পাখিটিকে মুক্ত করে দেওয়া হোক। আমি জানি এটি আমার কাছে ফিরে আসবেই।”
‘পাখি নিয়ে রাজনীতি’
অনলাইনে ছড়ানো ভিডিওতে সারসের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বের ঘটনাটি যখন বেশ প্রশংসিত, সেসময় এই পাখি নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক। রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলেছে।
বিরোধী দলীয় নেতা অখিলেস যাদব বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, আরিফের সঙ্গে তার দেখা করার পরই সারস পাখিটিকে জব্দ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাখিটির সঙ্গে একটি ছবিও তুলেছেন তিনি। যদিও এই অভিযোগ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি রাজ্য সরকার।
এর পেছনে রাজনীতি থাকুক বা না থাকুক বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ সমীর কুমার সিনহা মনে করেন, ‘অভয়ারণ্যে পাখিটিকে ছেড়ে দেওয়াটাই সঠিক সিদ্ধান্ত’। ভারতের ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টে সারস সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
“পাখি সংরক্ষণ এবং আবেগ দুটি ভিন্ন বিষয়। আপনি একটি পাখিকে উদ্ধার করতে পারেন, কিন্তু আপনাকে তা আইনের হাতেই সমর্পণ করে দিতে হবে।”
আর সেটা না হলে অন্যরাও পাখি পোষার আগ্রহ পাবে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “বন্যপ্রাণির স্বভাব বন্য। পাখিটি যদি কাউকে আক্রমণ করে বসে, তখন কী হবে?
“যদি সত্যিকার অর্থেই সারসকে সাহায্য করতে চান, সেক্ষেত্রে সঠিক হল পাখির জলাভূমিগুলো বাঁচানো; এরপর প্রকৃতিকে তার নিজের পথ বেছে নিতে দিন।”
আরও পড়ুন-