নাভালনির মৃত্যু: কেমন সেই কুখ্যাত বন্দিশালা

আইকে-৩ কারাগারে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলেই বন্দীদের মাইনাস ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কোট ছাড়াই দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বাইরে; যারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না, তাদের ডোবানো হয় বরফজলে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2024, 07:36 AM
Updated : 17 Feb 2024, 07:36 AM

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক বিরোধী ও বন্দিদের রাখা হত পৃথিবীর সর্বউত্তরের বা সুমেরু বৃত্তের বিশেষ একটি অঞ্চলে, যেটি স্বাভাবিক সমাজ বা সভ্যতা থেকে পুরোটাই বিচ্ছিন্ন।

কোনো দর্শনার্থীর সেই জায়গা যাওয়া প্রায় অসম্ভব। শীতকালে সেখানে তাপমাত্রা নামে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।

১৯৬১ সালে গড়ে তোলা সেই বন্দিশালায় রাখা হত দুর্ধর্ষ আসামিদের; বাধ্য করা হত জোরপূর্বক শ্রমে, সমাজ ব্যবস্থা থেকে তাদের রাখা হত একেবারে বিচ্ছিন্ন।

সোভিয়েত যুগের সেই কুখ্যাত কারাগারের নাম ‘আইকে-৩’, যা ‘পোলার উলফ’ বা ‘মেরু নেকড়ে’ নামেও পরিচিত। ভয়ানক অপরাধীদের এই কারাগারে রাখা হলেও রাশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে সেখানে রাখা হয়েছিল উগ্রপন্থায় উস্কানি এবং ওই সংক্রান্ত একটি সংগঠন চালানোর মত অভিযোগে।

গত ডিসেম্বর থেকে ওই কারাগারে বন্দি ছিলেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর সমালোচক নাভালনি। কিন্তু শুক্রবার হঠাৎ তার মৃত্যুর খবর দেয় রুশ কর্তৃপক্ষ।

তার এমন মৃত্যু নিয়ে গোটা বিশ্বেই হচ্ছে আলোচনা। যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো নাভালনির ‍মৃত্যুর পেছনে পুতিনকেই দায়ী করছে। তাকে খুন করা হয়েছে বলেও দাবি তুলেছে নাভালনির পরিবার ও বিরোধী শিবির।

নাভালনির শিবির বলছে, তার মৃত্যুর বিষয়টি তারা নিশ্চিত নন। তবে কারা কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুর যে খবর জানিয়েছে, সেটি তাদের নাভালনিকে খুন করারই স্বীকারোক্তি বলে তারা মানছেন।

গত বছর অগাষ্টে ১৯ বছরের কারাদণ্ড পাওয়ার পর পোলার উলফে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়েছেন নাভালনি। তার বয়স ছিল মাত্র ৪৭ বছর। তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে।

বিবিসি জানিয়েছে, পোলার উলফের আগে নাভালনি বন্দি ছিলেন মেলেখভো কলোনিতে। মস্কো থেকে চার ঘণ্টার দূরত্বের এই কলোনিতে তিনি দুই বছর জেল খেটেছেন।

কারাগারে থাকার সময় নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। সম্ভবত সেটি ২০২০ সালে নভিচক বিষক্রিয়ার প্রভাবে। তার পিঠ ও পেটে ব্যথা, পা অসাড় হয়ে যাওয়ার কথা জানা গিয়েছিল। তাকে সঠিক চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

আইকে-৩ কারাগারে ভেতরে রুশ জাতীয় সংগীত বাজানোর জন্য কারারক্ষীরা কীভাবে ভোর ৫টায় বন্দিদের জাগিয়ে তোলে, গত ২২ জানুয়ারি সেই বর্ণনা দিয়েছিলেন নাভালনি। জাতীয় সংগীত বাজানোর পরপরই দেশের দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গান শামানের ‘ইয়া রাস্কি’ বা ‘আমি রাশিয়ান’ বাজানো হত, যেটি মূলত ভ্লাদিমির পুতিনের অনানুষ্ঠানিক সংগীত হয়ে উঠেছে।

গত ডিসেম্বরে তাকে মেলেখভো থেকে ১ হাজার ৯৩০ কিলোমিটার দূরে খার্পে নেওয়া হয়। ওই যাত্রার বর্ণনা দেওয়ার সময়ও তার মুখে হাস্যরস ছিল।

রসিকতা করে নাভালনি বলেছিলেন, “আমাকে সেখানে নেওয়ার কুড়িটা দিন ছিল ক্লান্তিকর। কিন্তু আমি এখনো খোশ মেজাজে আছি, সান্তাক্লজের মতই।”

আইকে-৩ বা পোলার উলফ কারাগারে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে বন্দীদের দেওয়া হয় কঠিন শাস্তি। মাইনাস ৩০ ডিগ্রিতে নামা তাপমাত্রায় কোট ছাড়াই বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। আর যারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না, তাদের ডোবানো হয় বরফজলে।

সুমেরু বৃত্তের ওই অঞ্চলে পথঘাট মাসের পর মাস একটানা বরফে ঢাকা থাকে। মে মাসে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের উপরে উঠলে কর্দমাক্ত বরফ থাকে।

গরমের সময় বন্দিদের কোমর পর্যন্ত নগ্ন করে রাখা হয় মশার ঝাঁকের মধ্যে। এছাড়া গরমের মৌসুমে সেখানে সূর্যাস্ত যায় না। ফলে একটানা দীর্ঘ সময় কেবল দিনই থাকে, রাতের দেখা মেলে না। এগুলোর সবই বন্দিদের জন্য শারীরিক কঠিন নির্যাতন।

মস্কোর পূর্বে মেলাখভোতে আইকে-৬ কারাগারে নিঃসঙ্গ ছিলেন নাভালনি। এরপর গত ডিসেম্বর থেকে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে বিচ্ছিন্ন রাখা হচ্ছিল আইকে-৩ কারাগারে। কিন্তু সেখানে হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার পর তিনি মারা গেছেন বলে খবর দেওয়া হয়েছে।

রুশ কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, “নাভালনি হাঁটার পর অসুস্থ বোধ করেন এবং একটু পরই জ্ঞান হারান। দ্রুত চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স দলকে ডাকা হয়। তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। পরে চিকিৎসকেরা তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তার মৃত্যুর কারণ জানতে তদন্ত চলছে।”