সিএনএনের ভাষ্যে, এটা ইউক্রেইনে রুশ সামরিক অভিযানের উপর আঘাতই শুধু নয়, মস্কোর জন্য একটি বড় মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কাও।
Published : 09 Oct 2022, 11:17 PM
রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ইউক্রেইন থেকে অধিকৃত ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ সংযোগকারী ক্রাইমিয়া সেতু, যার নাম কের্চ সেতু, শনিবারের বিস্ফোরণের পর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে পুরো বিধ্বস্ত হয়নি।
শনিবার সিএনএন জানায়, সেতুতে এই বিস্ফোরণ রুশ মূল ভূখণ্ড এবং অধিকৃত উপদ্বীপের পরিবহন যোগাযোগকে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। এটা ইউক্রেইনে রুশ সামরিক অভিযানের উপর আঘাতই শুধু নয়, বরং মস্কোর জন্য একটি বড় মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কাও।
একইসঙ্গে এই ঘটনাকে কিইভের বিজয় অর্জনের প্রচারণার একটি বড় জয় হিসেবেও চিহ্নিত করেছে সিএনএন।
কী ঘটেছে?
সিএনএন বলছে, বিস্ফোরণের সঠিক কারণটি এখনও অস্পষ্ট। রুশ কর্মকর্তারা বলছেন, এটি জ্বালানিভরতি ট্রাক বিস্ফোরিত হয়েছে, কিন্তু সেতুর রাশিয়া থেকে ক্রাইমিয়ার দিকে যাওয়ার অংশের দুটো স্প্যান ধসে পড়ে বলেই জানা যাচ্ছে। এর পরপরই সেতুর আলাদা আরেকটি অংশে জ্বালানি ট্রাক বহন করা একটি ট্রেনে আগুন ধরে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ছবিতে দেখা গেছে, কের্চ সেতুর সড়কপথের একটি অংশ এবং রেল সেতু অংশটি জলরাশিতে পড়ে আছে এবং সেতুর ওপরে থাকা ট্রেনে আগুন জ্বলছে।
সেতুটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
২০১৪ সালে ইউক্রেইনের ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ দখল করার পর মস্কো একে রাশিয়ার অংশ হিসেবে অধিভুক্ত করে। এরপর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার প্রায় ৩৭০ কোটি ডলার খরচ করে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশাল এই সেতু নির্মাণ করে।
সিএনএন লিখেছে, ইউক্রেইনের অধিকার অর্জন এবং রাশিয়ার সঙ্গে স্থায়ীভাবে সংযুক্ত করার রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের যে লক্ষ্য তার বাস্তব প্রকাশ ছিলো এই সেতু নির্মাণ। যেদিন সেতুর উদ্বোধন করা হয়, সেদিন তিনি রাশিয়ার পতাকা সজ্জিত একটি ট্রাক চালিয়ে সেতুর উপর দিয়ে একটি গাড়ি বহরের নেতৃত্ব দেন।
কৃষ্ণ সাগর ও আজভ সাগর সংযোগকারী কের্চ প্রণালীর ওপর দিয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রণালীর ওপর ইউক্রেইনের মারিউপলসহ গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরগুলো নির্ভরশীল।
সিএনএনের ভাষ্যে, রাশিয়ার জন্য এই সেতু বাহ্যিকভাবে মূল রুশ ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রাইমিয়ার ‘পুনঃএকত্রীকরণের’ প্রতীক। ক্রাইমিয়ার মৌলিক চাহিদা- যেমন জ্বালানি ও পণ্য পরিবহনে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সেইসঙ্গে ইউক্রেইনে রুশ বাহিনীর অস্ত্র ও জ্বালানি সরবরাহেরও নিয়মিত পথ হিসেবে সেতুটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ইউক্রেইন কী বলছে?
ইউক্রেইনের কর্মকর্তারা সেতুসে এই আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সরাসরি বিস্ফোরণের দায় স্বীকার না করলেও এই ঘটনাকে একটি বিজয় হিসেবে দাবি করেছেন তারা।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ৭০ বছরে পা দেওয়ার পরদিন এই সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং ইউক্রেইনের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পরিষদের মন্ত্রী উলেস্কি দানিলভ ধসে পড়া সেতুর অংশ ও সেতুতে দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের ভিডিও এবং মেরিলিন মোনরোর ‘হ্যাপি বার্থডে, মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ গান গাওয়ার একটি ভিডিও পাশাপাশি রেখে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন।
অন্য অনেকে সেতুতে এই হামলার ঘটনাকে এপ্রিলে ইউক্রেইনের হামলায় রুশ নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ মস্কোভার ডুবে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
নিজেদের স্বীকৃত টুইটার অ্যাকাউন্টে এক সংক্ষিপ্ত পোস্টে কের্চ সেতুর এই বিস্ফোরণের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেইনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, “গাইডেড মিসাইল ক্রুজার মস্কোভা ও কের্চ সেতুর - ইউক্রেইনের ক্রাইমিয়ায় রাশিয়ার দুষ্ট শক্তির দুই প্রতীক - পতন হয়েছে। লাইনে এরপর কি আছে, রুশি?”
সেতুতে বিস্ফোরণের ঘটনায় ইউক্রেইনের নৌবাহিনী ফেইসবুকে পোস্টে বলেছে, “রুশ ফেডারেশনের বিমান প্রতিরক্ষা বিভাগ, তোমরা কি ঘুমাচ্ছ?” পাশাপাশি তারা সেতুর ধসে পড়া অংশের ভিডিওচিত্রও যুক্ত করেছে সেখানে।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া কী?
ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণেই আছে এবং সেতু দ্রুত মেরামত করা হবে- পুতিনের সরকরা সবাইকে এমন বার্তা দিতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে বলে জানিয়েছে সিএনএন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাস ‘হামলা’ শব্দটি এড়িয়ে গিয়ে তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে ৩৮০ জনের একটি দল, ৯০ ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে সেতুর ‘জরুরি মেরামত কাজ শেষ করতে’ রওনা হয়েছে।
রুশ পরিরহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা শনিবার সন্ধ্যার মধ্যেই সেতুর রেল সংযোগ অংশটির মেরামত শেষ করে ট্রেন চলাচল চালু করতে পারবে, যা ইউক্রেইনে রুশ বাহিনীর রসদ পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তাস আরও জানিয়েছে, ক্রাইমিয়ায় কের্চ সেতুর ‘জরুরি’ বিষয়াদি দেখভালের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে একটি ‘সরকারি কমিশন’ গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন পুতিন। প্রতিবেদনে জানানো হয়, রাশিয়ার জরুরি পরিস্থিতি মন্ত্রণালয় ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রধানেরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
রুশ কর্মকর্তারা জানিয়েছে, সেতুর ওপরে থাকা জ্বালানি ভর্তি ট্রাক থেকেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। রুশ তদন্ত কমিটির মুখপাত্র সভেৎলানা পেতেরেনকো জানান, ক্রাইমিয়া সেতুতে যে ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে একটি ফৌজদারী মামলার কার্যক্রম শুরু করেছে কমিটি।
প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, শনিবার সকালে ক্রাইমিয়ার সেতুতে সড়ক পরিহন পথের ওপর তামান উপদ্বীপ থেকে আসা (সেতুর পশ্চীমমুখী লেনে) একটি ট্রাক বিস্ফোরিত হয়, যা ক্রাইমিয়া উপদ্বীপগামী একটি চলমান ট্রেনের সাতটি জ্বালানি ট্যাংকে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরফলে সেতুর সড়ক যোগাযোগ অংশের দুটি লেন আংশিক ধসে পানিতে পড়ে যায়।
রুশ তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, ট্রাকটির মালিক কারাসনোদার কারি এলাকার বাসিন্দা এবং তার আবাসস্থলে তদন্ত অভিযান শুরু করা হয়েছে। ওই ট্রাকের ভ্রমণপথ ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্রও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। বিস্ফোরণের বিষয়ে এই রুশ ব্যাখ্যার সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি সিএনএন।
কী বার্তা দিচ্ছে?
বিস্ফোরণের ঘটনার পরপরই রাশিয়া ও ক্রাইমিয়ার মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেল পরিবহন যোগাযোগ স্থগিত করা হয়।
এদিকে কের্চ প্রণালীর আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে ক্রাসনোদার থেকে ক্রাইমিয়া নৌপথে ফেরি পরিচালনার রুশ পরিকল্পনাও ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে রুশ রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা। তারা জানিয়েছে, ইউক্রেইনের দক্ষিণাংশে রুশ সেনাদের সমুদ্রপথে ও সড়ক করিডোরের মাধ্যমে রসদ পৌছানো হবে বলে উল্লেখ করেছে রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তর।
শনিবার নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে একটি পোস্টে রুশ কতৃপক্ষের নিয়োগ করা ক্রাইমিয়ার প্রধান সেরগেই আকসেনভ এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন সেতুর অক্ষত অংশ দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, “এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ পরিদর্শন রীতিনীতি মেনে গাড়ি ও বাস চলাচল উন্মুক্ত করা হয়েছে। ট্রাক চালকদের কের্চ ফেরি ক্রসিং ব্যবহার করে চলাচল করার নির্দেশ দিয়েছি আমরা। দুই ঘণ্টার মধ্যে কের্চ-২ ফেরি এই প্রণালীতে চলাচল শুরু করবে।”
আকসেনভ ওই বিবৃতিতে জানিয়েছেন, শনিবার রাতের মধ্যেই ট্রেন চলাচলও শুরু করা সম্ভব।
রাশিয়ার কৌশল নির্ধারণে এর কী প্রভাব?
সিএনএন জানিয়েছে, খেরসন ও জাপোরিঝিয়ায় রুশ সেনাদের রসদ সরবরাহে এই সেতু ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল এবং এই বিস্ফোরণ তাতে কতোটা প্রভাব ফেলবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। ইউক্রেইনের দক্ষিণ ও পূর্বে রুশদের দখল করা অংশে সফলভাবে অভিযান এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিইভ।
শুক্রবার ইউক্রেইনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর খেরাসন অঞ্চলে ইউক্রেইনীয় সেনারা এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করেছে।