২০২১ সালের অগাস্টে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায় সেখানকার নারীদের জীবন।
Published : 16 Aug 2023, 06:02 PM
বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমে বক্সিং গ্লাভস মুখের কাছে নিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে ছিলেন নিনা, যিনি এখন নিজেকে রক্ষা করতে শিখছেন।
১৯ বছরের এই তরুণী বলছেন, তার আর কোনো উপায় নেই। শিক্ষার জন্য তালেবানের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি চলে এসেছেন বাংলাদেশে।
বিবিসি জানিয়েছে, মাতৃভূমিতে আর কখনও ফিরতে পারবে না জেনেও যেসব আফগান নারী বিদেশে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন, সেই কয়েকশ নারীদেরই একজন নিনা।
আফগান এই তরুণী বলেন, বছরখানেক আগে কাবুল বিমানবন্দরে হাঁটার সময়ও নিজেকে তার অসহায় ও দুর্বল মনে হচ্ছিল, তার হাত কাঁপছিল। তিনি জানতেন আফগানিস্তান থেকে পালানো বিপজ্জনক।
বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা যখন তার গন্তব্য জানতে চাইল, নিনা তখন মিথ্যা বলেছিলেন। তার কথায়, “নারীদের একা ভ্রমণ করার অনুমতি দেয় না তালেবান; তাই আমি বললাম, ‘পাকিস্তানে আমার মা অসুস্থ’।”
বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা তার কথায় আশ্বস্ত হলে সেই পরিস্থিতি থেকে তিনি পরিত্রাণ পেয়েছিলেন। কিন্তু আরও একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ তার জন্য বাকি ছিল। সেটি হল- বিমানে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি ও পরিবার থেকে তার দূরে সরে যাওয়া।
নিনা বলেন, “যেদিন আফগানিস্তান ছাড়ি, সেদিন আমি কাঁদছিলাম। কারণ আমি আমার মায়ের মুখ আর কখনও দেখতে পাব না। এটা আমার জন্য অনেক কঠিন। আমার ছোট বোনের মনটাও ভেঙে গেছে। যখন তাদের নিয়ে ভাবি, সেটি আমাকে পীড়া দেয়।”
‘এক হাজার নারীকে বের করে আনতে চাই’
মার্কিন নেতৃত্বাধীন নেটো জোট আফগানিস্তান ছেড়ে গেলে ২০২১ সালের অগাস্টে ফের কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। এরপরই সেখানকার নারীদের জীবন নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়।
১২ বছর বয়সের পর তারা শিক্ষার অধিকার হারায়। নিজেদের পছন্দসই পোশাক পরার অধিকার এবং ৭২ কিলোমিটারের বেশি একা ভ্রমণের অধিকারও হারিয়ে ফেলে।
সেসময় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) কর্মসূচির আওতায় বিদেশে শিক্ষার জন্য যেসব আফগান শিক্ষার্থীদের প্রস্তাব করা হয়েছিল, নিনা তাদেরই একজন। তালেবান ক্ষমতায় আসার পরপরই আফগান শিক্ষার্থীরা সাহায্যের জন্য এইউডব্লিউ-কে ফোন করছিল।
এইউডব্লিউ’র প্রতিষ্ঠাতা কামাল আহমেদ বলেন, তিনি জানতেন এই শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে হবে।
পশ্চিমা বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ার পরই সেখনকার ১৪৮ শিক্ষার্থীর দলকে বের করে আনার ব্যবস্থা করেন। সাতটি কোচ কাবুল বিমানবন্দরে মোট তিনবার সেই বিপজ্জনক যাত্রা করে।
২০২১ সালের ২৬ অগাস্ট এসব আফগান নারীরা যখন বিমানবন্দরের বহিঃগর্মন এলাকায় অবস্থান করছিলেন, সেই মুহূর্তে বিমানবন্দরের একটি গেইটে ভিড়ের মধ্যে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১৫০ জন নিহত হয়েছিলেন।
কামাল আহমেদ বলেন, “বিমানবন্দর পর্যন্ত একটি দুঃসহ যাত্রার পর তারা মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি ফ্লাইটে উঠেছিল এবং সফলভাবে সৌদি আরবে নেমেছিল। ১৪৮ জনের সকলেই এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে। আর আমি কেবল স্বস্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে, এই প্রচেষ্টায় খারাপ কিছু ঘটেনি।”
এরপর থেকে এইউডব্লিউ বৃত্তি দিচ্ছে এবং আফগানিস্তান থেকে আরও শত শত নারীকে সরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করেছে। এখন পর্যন্ত তারা আফগানিস্তান থেকে ৪৫০ জনকে সরিয়ে নিয়েছে। এই শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এইউডব্লিউ এর নিজস্ব ক্যাম্পাসে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও ম্যানচেষ্টারে অংশী কলেজগুলোতে।
এমন আরও আফগান নারীকে সাহায্য করতে চায় এইউডব্লিউ। শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়ে নিরাপদে আফগানিস্তান থেকে এক হাজার নারীকে বের করে আনার লক্ষ্য রয়েছে তাদের।
‘ইরানে স্বামীকে ছেড়ে এসেছি’
আফগান নারী শিক্ষার্থীদের তালেবান শাসনের যাঁতাকল থেকে বের করে আনার কার্যক্রমের আরেকজন সুবিধাভোগী সাফিয়া। ২০ বছর বয়সের সময় তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
যে রাতে তালেবানরা কাবুল দখল করে, সেই রাতে তিনি কাজে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তালেবান ক্ষমতা দখলের পর তিনি যে টেলিভিশন স্টুডিওতে কাজ করতেন, সেটি খুব শিগগিরই বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেইসঙ্গে থেমে যায় তার ক্যারিয়ারও।
সাফিয়া বলেন, তালেবানের নতুন বিধিনিষেধের কারণে কয়েক সপ্তাহ বাড়ি ছাড়াও তার জন্য কঠিন ছিল।
“একদিন আমি লাল কাপড় পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং তালেবান আমাকে অপহরণের চেষ্টা করেছিল। আমাকে একটি বাক্সে আটকে রেখেছিল, কারণ আমি আপাদমস্তক কালো কাপড় পরেছিলাম না। সেই অভিজ্ঞতা ছিল বীভৎস।”
আটককারীরা সাফিয়াকে পোস্ট অফিসে গিয়ে তার পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও মোবাইল জমা দিতে বললেও তিনি দৌড়ে পালিয়ে যান।
“আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, তারা আমাকে পেছন থেকে গুলি করবে। এটি বোঝার পরও আমি জানতাম, আমাদের সংস্কৃতিতে তালেবানের হাতে বন্দী হওয়ার চেয়ে মৃত্যু ভালো। আমি চিৎকার করে বলছিলাম, পোস্ট অফিসে যাব না এবং তারপর সর্বশক্তি দিয়ে আমি দৌড় দিয়েছিলাম।”
সাফিয়া জানান, তিনি রাস্তায় চলন্ত গাড়ির পাশ দিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন, বেশকিছু গাড়ির সঙ্গে ধাক্কাও লেগেছিল। কিন্তু একটি দোকানে না পৌঁছানো পর্যন্ত তার দৌড় থামছিল না। সেই মুহূর্তে তার স্বামী যখন তাকে খুঁজে পেলেন, সাফিয়া কথা বলতে পারছিলেন না।
সাফিয়া বলেন, এরপর তালেবান কখনই তাকে খুঁজতে আসেনি। কিন্তু সেটি ছিল তার শাস্তির সাময়িক বিরতি স্বরূপ। পরবর্তীতে তার কোনো চাকরি ছিল না, বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকতেন, ভয় পেতেন বাইরে যেতে।
এর কয়েক মাস পর তিনি এইউডব্লিউ এর স্কলারশিপের অফার পেলেন। তার প্রত্যাশা, পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তিনি তার পরিবারকে সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু কখন তিনি স্বামীসহ পরিবারের অন্যদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন, সে ব্যাপারে কিছু জানেন না।
সাফিয়া জানান, তার স্বামী তাকে আফগানিস্তান ছাড়তে সাহায্য করেছিল। তারা কোথায় যাচ্ছেন, সে ব্যাপারে বিমানবন্দর কর্মকর্তাদের মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন।
বিমানবন্দরে তাকে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। বিয়ের সনদপত্র দেখাতে হয়েছিল সেখানে প্রবেশের জন্য।
“আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী কিনা, সেটি প্রমাণের জন্য তারা যাচাই করে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের ঢুকতে দেয়, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা ছিল খুব কঠিন।
“এরপর আমাকে ইরান, দুবাই হয়ে শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামে আসতে হয়। ইরানে আমার স্বামীকে ফেলে আসতে হয়েছে, খুব কঠিন অভিজ্ঞতা সেটি।”
চট্টগ্রামে এইউডব্লিউ ক্যাম্পাসে ‘প্রি-আন্ডারগ্র্যাজুয়েট’ লেভেলে পড়া সাফিয়া জানান, মাতৃভূমিতে তিনি আর ফিরতে চান না। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরার জন্য সাংবাদিক প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
“যেসব নারীরা অধিকার হারিয়েছে, ব্যক্তিগতভাবে আমি তাদের কণ্ঠস্বর হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার পরিবার চেয়েছিল, নিজের নিরাপত্তার জন্যই যেন আমি সেখান (আফগানিস্তান) থেকে চলে যাই।”
যেদিন চিরতরে পরিবার ছেড়ে এসেছিলাম
নিনা বাংলাদেশে আসুক, সেটিই চাইতেন তার মা-বাবা। কিন্তু পরিবারকে ছেড়ে যাওয়া এবং তাদের ঝুঁকি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন নিনা। এছাড়া নতুন সংস্কৃতি ও ভাষায় খাপ খাওয়ানো নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে তার দ্বিতীয় সেমিস্টারের মধ্যে নিনা একটি বক্সিং ক্লাব খুলে বসেন। এখন তার সেই ক্লাবে ৫০ জন নারী শিক্ষার্থী রয়েছেন।
আত্মরক্ষা এবং শক্তি নারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন নিনা। তার কথায়, “সবসময় আমি নিজেকে রক্ষায় সক্ষম হতে চেয়েছি। অন্যদেরও সেই একই কাজ করতে শেখাই।”
সাত বছর ধরে স্কুলে কঠোর পরিশ্রম আর জিমে নিয়মিত বক্সিং করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “২০২১ সালের অগাস্টের পর থেকে আমি জিমে যেতে পারিনি। আমি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারিনি, এমনকি বাইরেও যেতে পারিনি।
“তালেবান আফগানিস্তানকে ২০ বছর পিছিয়ে নিয়ে গেছে। আমি কেঁদেছি। অবস্থা খুবই ভয়ঙ্কর।”
তিনি শক্তি আর আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়ন চান। নিনা ও সাফিয়ার মত আফগান শিক্ষার্থীদের সকলেই পেছনে তাদের জীবন ফেলে এসেছেন এবং ভবিষ্যত গড়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারা যাদের ভালোবাসেন, তাদের এখন ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
নিনা বলেন, “আমি আফগানিস্তানের নারীদের মুক্তি কামনা করি। কারণ আমি জানি, তারা অনেক চেষ্টা করছে। বিশ্বাস করি, একদিন তারা তাদের স্বপ্নের পথে চলতে পারবে।”
আফগানিস্তান ছেড়ে আসা নারী শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকেই জানান, কিছু সাধারণ বিষয় তাদের সবার মধ্যেই রয়েছে। ফেলে আসা আফগান নারীদের তারা কখনও ভুলবে না।
আরও পড়ুন-
আফগানিস্তান: মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ বন্ধই করে দিল তালেবান