আফগান নারীদের শিক্ষায় এখন বড় বাধা বাজে ইন্টারনেট

সমস্যার মধ্যে রয়েছে ইন্টারনেটের গতি কমে যাওয়া থেকে শুরু করে কম্পিউটার ও ওয়াইফাই খরচ বেড়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো, তাও এমন এক দেশে যেখানে ৯৭ শতাংশ মানুষই দরিদ্র।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2023, 11:59 AM
Updated : 27 March 2023, 11:59 AM

গোটা বিশ্বে নারী শিক্ষা বিরোধী সবচেয়ে বড় শক্তি সম্ভবত আফগানিস্তানের তালেবান কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যেও দেশটিতে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিশোরী ও নারীদের জন্য বাড়িতে ডিজিটাল উপায়ে শিক্ষার আলো পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তবে, নানা দিক থেকে বাধা আসছে সে উদ্যোগেও।

কাবুলের তরুণী শিক্ষার্থী সোফিয়া শিখতেতে চান ইংরেজি। কোর্সের জন্য অনলাইনে লগ ইন করে অপেক্ষায় থাকেন।

সমস্যা হলো, শিক্ষকরা সোফিয়াকে কোর্সের কোনো অনুচ্ছেদ পড়তে বললে তখন তার কম্পিউটার স্ক্রিন ‘হ্যাং’ হয়ে যায়।

“আপনি কী আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?” --ক্রমাগত জিজ্ঞেস করার পাশাপাশি নিজের ইন্টারনেট সংযোগ পরীক্ষা করে দেখতে হয় তাকে।

কিছুক্ষণ পরে হয়ত প্রাণ ফিরে পায় তার কম্পিউটার।

‘বরাবরের মতোই’ ক্লাস আবার শুরুর পরপরই দুর্বল যোগাযোগে একইরকম হতাশ হন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তার অন্য সহপাঠীরা।

তালেবান প্রশাসনের অধীনে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়া আফগান কিশোরী ও নারীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার বিপরীতে অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের শেষ প্রচেষ্টা চালানোদের একজন হলেন এই ২২ বছর বয়সী সোফিয়া।

তালেবান কর্মকর্তারা ইসলামিক পোশাক সম্পর্কিত নানা রকম সমস্যার কথা বলে থাকেন। এরা মেয়েদের উচ্চ বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রবেশে বাধা দেয় ও বেশিরভাগ নারীকে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থায় কাজ করা থেকে বিরত রাখে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যখন প্রথম তালেবানরা ক্ষমতায় আসে, তখন তাদের আনা অন্যতম চমকপ্রদ পরিবর্তন ছিলো ইন্টারনেটের বহুল ব্যবহার।

“আফগানিস্তানে ইন্টারনেট সংযোগ খুবই জটিল। আর মাঝে মাঝে আমরা ২৪ ঘণ্টা মধ্যে কেবল আধা ঘণ্টা বিদ্যুত সংযোগ পাই।”

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করার ওই সময়টিতে কার্যত কারও কাছেই ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার ছিল না।

বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রায় দুই দশক পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন হস্তক্ষেপ ও বিশ্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার পর দেশটির জনগণের ১৮ শতাংশ ইন্টারনেটের সংযোগ পাচ্ছেন।

তালেবান প্রশাসন মেয়েদের বাড়িতে স্বতন্ত্রভাবে পড়াশোনা করার অনুমতি দিয়েছে, আর ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়নি।

তবে, এই আশার মধ্যেও আঁধার হানা দেয় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে। এর ফলে  দেশটিতে নারী ও কিশোরীদের জন্য তৈরি হচ্ছে বেশ কয়েকটি সমস্যা। এর মধ্যে রয়েছে ইন্টারনেটের গতি কমে যাওয়া থেকে শুরু করে কম্পিউটার ও ওয়াইফাই খরচ বেড়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো, তাও এমন এক দেশে যেখানে ৯৭ শতাংশ মানুষই দরিদ্র।

“আফগানিস্তানে নারীদের জন্য ইন্টারনেটের সমস্যাটি খুবই বাজে।” --বলেন সোফিয়া।

তিনি যে অনলাইন স্কুলে ক্লাস করেন, সেটির নাম হলো ‘রুমি একাডেমি’। ২০২১ সালে তালেবান প্রশাসন ক্ষমতা দখলের পর প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের অনলাইন ক্লাসের ভর্তি সংখ্যায় বেশিরভাগই নারী শিক্ষার্থী পেয়েছে। সংখ্যার হিসাবে যেটি ৫০ ছাত্রী থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচশতে।

প্রতিষ্ঠানটিতে এখনও শতাধিক আবেদন জমা পড়ে আছে। তবে, শিক্ষকদের জন্য আর্থিক তহবিল, বিভিন্ন দরকারি জিনিসপত্র আর ইন্টারনেট প্যাকেজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ঘাটতির ফলে তাদের ভর্তি করে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না বলে জানান একাডেমির এক প্রতিনিধি।

‘বেশি জটিল’

ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগে বাধ্য হন সাকিনা নাজারি। পশ্চিম কাবুলের এই তরূণী চেষ্টা করেন ভার্চুয়াল ল্যাংগুয়েজ ক্লাসে যোগ দেওয়ার। রয়টার্সের প্রতিবেদন বলছে, এ নিয়ে লড়াইয়ের পর হতাশ হয়েই সেই পরিকল্পনায় ইস্তফা দিয়েছেন তিনি।

“আমার পক্ষে আর এটা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।” --বলেন তিনি।

“আফগানিস্তানে ইন্টারনেট সংযোগ খুবই জটিল। আর মাঝে মাঝে আমরা ২৪ ঘণ্টা মধ্যে কেবল আধা ঘণ্টা বিদ্যুত সংযোগ পাই।”

সিয়াটল ভিত্তিক বৈশ্বিক ইন্টারনেটের গতিবিষয়ক তথ্য সংগ্রাহক কোম্পানি ওকলা বলছে, আফগানিস্তানের মোবাইল ইন্টারনেট ১৩৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম গতির ও এর সামগ্রিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা ১৮০টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় মন্থরতম।

স্পেসএক্স-এর প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ককে এরইমধ্যে আফগানিস্তানে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর আহ্বান জানাচ্ছেন কয়েকজন আফগান নাগরিক। নিজস্ব মালিকানাধীন সামাজিক প্ল্যাটফর্ম টুইটারে সাহায্যের বিভিন্ন পোস্ট দেখে ইরান ও ইউক্রেইনে একই ব্যবস্থা চালু করেন মাস্ক।

“আমরা ইলন মাস্ককেও সহযোগিতার আহ্বান জানাতে পারি।” --বলেন সোফিয়া।

“তারা আফগানিস্তানে এটি চালু করতে পারলে তা দেশটির নারীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হবে।”

এই প্রসঙ্গে রয়টার্স স্পেসএক্স মুখপাত্রদের মন্তব্য জানতে চাইলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।

আফগানিস্তানের শিক্ষার্থীদের জায়গা করে দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে দেশটির বিভিন্ন অনলাইন স্কুল।

তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১৫ হাজারের বেশি আফগান কিশোরী ও নারীর আবেদন পাওয়া অনলাইন ভিত্তিক ‘ইউনিভার্সিটি অফ দ্য পিপল’-এর মুখপাত্র ড্যানিয়েল কালম্যানসন বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থিরা নিজের পছন্দের যে কোনো সময়ই লেকচারে যোগ দিতে পারেন। পাশাপাশি, এখানকার অধ্যাপকরাও দূর্বল সংযোগের মুখে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বর্ধিত সময়ে অ্যাসাইনমেন্ট ও পরীক্ষা নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছেন।

আফগানিস্তানে বেশ কিছু কমিউনিটি ভিত্তিক স্কুল পরিচালনা করা ‘লার্ন আফগানিস্তান’ নামের এক অলাভজনক দল দেশটির প্রধান ভাষাগুলোর পাঠ্যক্রম বিনামূল্যে দিচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।

দলের নির্বাহী পরিচালক পাশতানা দুরানি বলেন, বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় বহুল ব্যবহৃত রেডিও’তে এইসব পাঠ্য চালুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে দলটি। এ ছাড়া, দুর্বল ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারের সমাধান খুঁজতে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গেও কাজ করলেও তিনি বলেন, এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারেননি তিনি।

“আফগানিস্তানের এমন এক দেশ হতে হবে, যেখানে ইন্টারনেটে প্রবেশ করা ও বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস সংযোগ করা যায়।” --বলেন দুরানি।

সোফিয়া বলেন, আফগান নারীরা বছরের পর বছর যুদ্ধের কারণে এমন সমস্যায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আর ফলাফল যাই হোক না কেন, তারা এতে অটল থাকবেন।

“আমাদের এখনও স্বপ্ন আছে। আর আমরা কখনওই হাল ছাড়ব না।”