এই পরোয়ানায় কি কাঠগড়ায় আনা যাবে পুতিনকে?

আইসিসি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও রুশ প্রেসিডেন্টকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে, এমন কোনো ইঙ্গিত মিলছে না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2023, 10:14 AM
Updated : 18 March 2023, 10:14 AM

ইউক্রেইনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-আইসিসি; তবে সেটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ ছাড়া আর কিছু নয়।

জাতিসংঘের দৃঢ় বিশ্বাস, ইউক্রেইনে যুদ্ধাপরাধের জন্য রুশ নেতাকে অভিযুক্ত করার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

তবে এ ধরনের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে বাস্তব ও যৌক্তিক জটিলতার শেষ নেই।

ফলে পুতিনকে আসলেই বিচারের মুখোমুখি করা যাবে কি না, কী কী সংকট রয়েছে, সেইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে জারি করা আইসিসির পরোয়ানা ইউক্রেইন যুদ্ধেই বা কতটুকু প্রভাব ফেলবে, তা খতিয়ে দেখেছে বিবিসি।

পুতিনকে গ্রেপ্তার করা যাবে?

পুতিন এখন নিজ দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী, ফলে তাকে আইসিসির কাছে ক্রেমলিনের হস্তান্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই। যতদিন তিনি রাশিয়ায় থাকবেন, ততদিন গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি নেই।

রাশিয়ার বাইরে গেলে পুতিন আটক হতে পারেন। কিন্তু ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় তার চলাফেরা ইতোমধ্যে সীমিত হয়ে গেছে। তাই যে দেশ তাকে বিচারের আওতায় আনতে চায়, সেখানে পুতিনকে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে হামলার শুরুর পর প্রেসিডেন্ট পুতিন মাত্র আটটি দেশে সফর করেছেন। এর মধ্যে সাতটি দেশ রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী, অর্থাৎ ১৯৯১ সালের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগে তারা রাশিয়ার সঙ্গেই ছিল।

এই দেশগুলোর বাইরে আরেকটি দেশে তিনি সফর করেছেন, সেটি হল ইরান। গত বছরের জুলাইয়ে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনির সঙ্গে দেখা করেন পুতিন। যেহেতু ইউক্রেইন যুদ্ধে ইরান ড্রোন ও অন্যান্য সামরিক রসদ দিয়ে রাশিয়াকে সাহায্য করছে, তাই পুতিন ইরানে আবার গেলেও তার বিপদে পড়ার সম্ভাবনা নেই।

আসলেই বিচারের মুখোমুখি হবেন?

এই ক্ষেত্রে অন্তত দুটি বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমত, রাশিয়া আইসিসির এখতিয়ার বা কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। ২০০২ সালে ‘রোম সংবিধি’ অনুযায়ী আইসিসি গঠিত হয়েছিল। ফলে এর আদেশ কেবল সেসব দেশের জন্যই খাটে, যারা ওই চুক্তিতে সই করেছিল।

আইসিসির আইন অনুযায়ী, চুক্তিতে সই করা দেশগুলোর কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগ উঠলে সেই দেশ নিজস্ব ফৌজদারি কর্তৃত্ব প্রয়োগ করবে। আর সেই দেশগুলো যদি তদন্ত ও বিচার করতে না পারে, তখনই কেবল আইসিসি সেখানে হস্তক্ষেপ করবে।

সব মিলিয়ে ১২৩টি দেশ আইসিসির চুক্তিতে সই করেছে, রাশিয়াসহ কিছু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশ এতে এখনও সই করেনি।

আইসিসি গঠনের চুক্তিতে রাশিয়া সই না করায় সংস্থাটির পরোয়ানায় রাশিয়া থেকে কাউকে প্রত্যর্পণের বাধ্যবাধকতাও দেশটির নেই।

সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, “আমাদের দেশের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের ওই আদেশে অর্থহীন, এমনকি আইনি দৃষ্টিকোণ থেকেও ওই আদেশ কোনো অর্থ বহন করে না।

“রাশিয়া রোম সংবিধিতে সই করা দেশ নয়, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতেরও অংশীদার নয়। ফলে ওই আদালতের আদেশ মানার কোনো দায়ও আমাদের নেই।”

আবার এই পরোয়ানাকে স্বাগত জানানো ইউক্রেইনসহ কয়েকটি দেশ চুক্তিতে সই করেছে, তবে অনুসমর্থন দেয়নি এখনও। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পুতিনের বিপক্ষে আইনি অবস্থান নড়বড়ে।

দ্বিতীয়ত, বিবাদী ছাড়া কাঠগড়ায় বিচার পরিচালনার বিষয়টি সবার অজানা না হলেও, এটি এখানে খাটছে না। আইসিসি কারও অনুপস্থিতে বিচার করে না, তাই সেই পথটিও বন্ধ।

আর কারা আওতায় এসেছেন?

মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের ধারাটি রয়েছে আইসিসি প্রতিষ্ঠার আগে থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়াল দিয়ে এর শুরু হয়। যুদ্ধের সময় গণহত্যা ও অন্যান্য নৃশংস কর্মকাণ্ডের ঘটনায় নাৎসি জার্মানির সদস্যদের বিচারের আওতায় আনতে এটি গঠন করা হয়েছিল।

এই ট্রায়ালের আওতায় এসেছিলেন নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের ডেপুটি রুডলফ হেস। তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং ১৯৮৭ সালে আত্মঘাতী হয়ে মারা যান তিনি।

অবশ্য পুতিনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি; যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস যুক্তি দিয়েছেন, এই অভিযোগও আনা উচিৎ।

Also Read: যুদ্ধাপরাধ: পুতিনকে গ্রেপ্তারে আইসিসির পরোয়ানা

Also Read: ন্যায্য অভিযোগ, পুতিন যুদ্ধাপরাধ করেছেন: বাইডেন

পুতিনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হলে আরেকটি আইনি সংকট তৈরি হবে; জাতিসংঘ যেমন নিজেই বলেছে- গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিপরীতে মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোকে একটি স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক আইনে শ্রেণিভুক্ত করা হয়নি। তবে সেটি করার চেষ্টা চলছে।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করতে চেয়েছে অন্য স্বতন্ত্র সংস্থাগুলো। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল; জাতিসংঘের এই সংস্থাটির অস্তিত্ব ছিল ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত।

এই ট্রাইবুনাল গঠনের পর ৯০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ‘সবচেয়ে কুখ্যাত’ সাবেক যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচ ২০০৬ সালে বন্দি অবস্থায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।

আইসিসি পুতিন বাদেও ৪০ জনকে অভিযুক্ত করেছে, যাদের সবাই আফ্রিকান দেশগুলোর। এদের মধ্যে ১৭ জনকে নেদারল্যান্ডসের হেগে আটক করা হয়েছে, ১০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

তাহলে পরোয়ানার মানে কী?

পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি সংকেত হিসেবে দেখছে যে, ইউক্রেইনে যা হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি।

আইসিসি বলেছে, ইউক্রেইনে যুদ্ধাপরাধ অব্যাহত রয়েছে। পরোয়ানার মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

কিন্তু এতে রাশিয়া প্রতিক্রিয়া হল, এই পরোয়ানা অর্থহীন।

ইউক্রেইনে রুশ বাহিনীর নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ক্রেমলিন। পুতিনের মুখপাত্র আইসিসির সিদ্ধান্তকে ‘অদ্ভুত ও অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

বিবিসির প্রতিবেদনে উপসংহার টানা হয়েছে, এ ধরনের অবাধ্যতার পরিস্থিতিতে আইসিসির পদক্ষেপ ইউক্রেইনে যুদ্ধের উপর কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। সেইসঙ্গে পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নির্দয়ভাবে মানুষকে পিষে যেতে যাবে।