এই অভিযান সফল হলে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে একটি রোবটযান নামাতে সক্ষম হবে। চাঁদের ওই অংশ এখনও খুব কমই জানে মানুষ।
Published : 14 Jul 2023, 03:07 PM
বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারতকে চাঁদে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে মহাকাশে রওনা হয়েছে চন্দ্রযান-৩।
শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ৩৫ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে এ মহাকাশযানের সফল উৎক্ষেপণ হয়।
ঐতিহাসিক এ মুহূর্তের সাক্ষী হতে ভারতের শতকোটি মানুষের চোখ ছিল টেলিভিশন আর সোশাল মিডিয়ায়। আগ্রহ নিয়ে নজর রেখেছেন বিশ্বের অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরাও।
অভিযান সফল হলে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে একটি রোবটযান নামাতে সক্ষম হবে। চাঁদের ওই অংশ এখনও খুব কমই জানে মানুষ।
চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার আগামী ২৩ বা ২৪ অগাস্ট চাঁদে অবতরণ করবে বলে আশা করছেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
এর আগে কেবল যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মহাকাশযান নিরাপদে চাঁদের মাটিতে নামতে পেরেছে।
চাঁদে পৌঁছানোর চেষ্টায় এর আগে দুটো অভিযান চালিয়েছে ভারত। ২০০৮ সালে প্রথম অভিযানে চন্দ্রযান-১ পৌঁছেছিল চাঁদের কক্ষপথে। চাঁদের ভূপৃষ্ঠের গঠন ও পানির উপস্থিতি নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা চালানো হয় সে সময়। দিনের বেলায় চাঁদে যে একটি বায়ুমণ্ডল সক্রিয় থাকে, ওই গবেষণাতেই তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
২০১৯ সালের দ্বিতীয় অভিযান আংশিকভাবে সফল হয়েছিল। চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার আজও চাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিণ করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু এর ল্যান্ডার অবতরণের সময় শেষ মুহূর্তের জটিলতায় চাঁদের মাটিতে বিধ্বস্ত হয়।
ইসরোর প্রধান শ্রীধরা পানিকার সোমানাথ বলেন, আগের অভিযানের তথ্য তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে এবারের অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, যাতে চন্দ্রযান-৩ কোনো জটিলতায় না পড়ে।
বিবিসি জানিয়েছে, ঐতিহাসিক এই উৎক্ষেপণ নিজের চোখে দেখতে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিড় করেছিলেন শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্রের বাইরে। ভর দুপুরে রোদের মধ্যে অনেকের মাথায় ছিল ছাতা। অনেকে আবার হাতে থাকা ভারতীয় পাতাকা দোলাচ্ছিলেন বাতাসে।
সুস্মিতা মোহন্তে নামের একজন স্পেস অন্টারপ্রনার বিবিসিকে বলেন, “এ যেন ক্রিকেটের ফাইনাল ম্যাচ! আমি নিশ্চিত, সবার চোখ এখন টেলিভিশনে।”
স্পেস মিশন নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কাউন্ট ডাউন কমতে কমতে শূন্য সেকেন্ডে আসার পর বিপুল ধোঁয়ার মেঘের মধ্যে লঞ্চপ্যাড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এলভিএম-৩ রকেট, যার মাথায় বসানো আছে চন্দ্রযান-৩। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে থাকা বিজ্ঞানী ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বাইরে জমায়েত হওয়া দর্শকরা করতালিতে ফেটে পড়ে।
এরপর সবকিছু ঠিকভাবেই চলে। জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে রকেটের সঙ্গে থাকা দুটো বুস্টার নির্ধারিত সময়ে আলাদা হয়ে সমুদ্রে পড়ে যায়। বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে থাকে চন্দ্রযান-৩। এক পর্যায়ে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, চন্দ্রযান-৩ কে সফলভাবে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে দিয়ে আলাদা হয়ে গেছে এলভিএম-৩ রকেট।
ভারতের মহাকাশ বিভাগের সচিব শ্রীধারা সোমনাথ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে উপস্থিত বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানান এবং সবার সঙ্গে হাত মেলাতে থাকেন। তিনি বলেন, “চাঁদের পথে যাত্রা শুরু করেছে চন্দ্রযান-৩।”
ভারতীয়দের জন্য এমন উপলক্ষ্যের দিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছিলেন ফ্রান্স সফরে। সেখান থেকে তিনি টুইট করেন, “ভারদের মাহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল চন্দ্রযান-৩।”
Chandrayaan-3 scripts a new chapter in India's space odyssey. It soars high, elevating the dreams and ambitions of every Indian. This momentous achievement is a testament to our scientists' relentless dedication. I salute their spirit and ingenuity! https://t.co/gko6fnOUaK
— Narendra Modi (@narendramodi) July 14, 2023
পৃথিবী থেকে চন্দ্রযান-৩ কে মহাকাশে পৌঁছে দিতে যে এলভিএম-৩ রকেট ব্যবহার করা হয়েছে, ভারতীয়রা তার নাম দিয়েছে ‘বাহুবলী’। রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর চন্দ্রযান-৩ নির্দিষ্ট কক্ষপথ ধরে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী থেকে দূরে সরতে থাকবে।
এক পর্যায়ে এ মহাকাশযান প্রবেশ করবে চাঁদের কক্ষপথে। নতুন এই ধাপে চাঁদকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করতে করতে দূরত্ব কমিয়ে আনবে চন্দ্রযান। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌঁছে শুরু হবে পরবর্তী ধাপ, অর্থাৎ অবতরণ পর্ব।
৩৯০০ কেজি ওজনের চন্দ্রযান-৩ বানাতে খরচ হয়েছে ৬.১ বিলিয়ন রুপি (সাড়ে ৭ কোটি ডলার)। ভারতের তৃতীয় চন্দ্রাভিযানের এই মহাকাশযান তৈরি হয়েছে অরবিটার, ল্যান্ডার ও রোভার- এই তিনটি অংশ নিয়ে।
ইসরোর প্রতিষ্ঠাতার নামে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডারের নাম রাখা হয়েছে বিক্রম, যার ওজন প্রায় দেড় হাজার কেজি। ওই বিক্রমই তার পেটের মধ্যে বহন করবে ২৬ কেজি ওজনের রোভার বা রোবটযান প্রজ্ঞানকে।
এই মহাকাশযান চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করতে সময় লাগবে ১৫ থেকে ২০ দিন। বিজ্ঞানীরা এরপর ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মহাকাশযানকে নিয়ে যাবেন, যেখান থেকে বিক্রমের অবতরণপর্ব শুরু হবে। নির্দিষ্ট সময়ে চন্দ্রযান-৩ এর অরবিটার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চাঁদের মাটিতে নেমে যাবে ল্যান্ডার বিক্রম।
অবতরণের সময়টা হতে হবে একেবারে নির্দিষ্ট, চাঁদের কোনো এক দিনের ঠিক সূচনায়। কারণ ল্যন্ডর আর রোভারের ব্যাটারি চার্জ হতে সূর্যালোক দরকার হবে।
বিক্রম ঠিকঠাক চাঁদে নামতে পারলে এর পেট থেকে বেরিয়ে আসবে ছয় চাকার প্রজ্ঞান। চাঁদের পৃষ্ঠে ঘুরে ঘুরে সে পৃথিবীতে পাঠাবে তথ্য আর ছবি। এই রোভার সক্রিয় থাকবে চাঁদের এক দিন, যা পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান।
পাঁচ ধরনের যন্ত্র বহন করছে চন্দ্রযানের রোভার। চন্দ্রপৃষ্ঠের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য, পৃষ্ঠের কাছাকাছি বায়ুমণ্ডল এবং ভূগর্ভে নিচে কী ঘটছে তা জানার চেষ্টা করবেন বিজ্ঞানীরা।
ইসরো প্রধান শ্রীধরা পানিকার সোমনাথ আশা করছেন, এই অভিযানে নতুন কিছু খুঁজে পাবেন তারা।
চাঁদের যে অংশে চন্দ্রযান পৌঁছাতে চায়, সেই দক্ষিণ মেরু নিয়ে মানুষের গবেষণা খুব বেশি এগোয়নি। ছায়ায় ঢাকা ওই অঞ্চল চাঁদের উত্তর মেরুর চেয়ে অনেকটা বড়। ধারণা করা হয়, সবসময় অন্ধকারে থাকা ওই অঞ্চলে পানির অস্তিত্ব থাকতেও পারে।
সোমনাথ বলেন, “আমরা যদি নতুন কিছুর সন্ধান পেতে চাই, তাহলে আমাদের চাঁদের এমন জায়গায় যেতে হবে, যে এলাকা নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। চাঁদের দক্ষিণ মেরু আমাদের সেই সুযোগ দিতে পারে। তবে ওই অংশে অবতরণের ঝুঁকিও অনেক বেশি।”
তিনি জানান, চন্দ্রযান-২ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় সমস্ত তথ্য তারা সংগ্রহ করেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন, যাতে আগেরবারের মত জটিলতা এড়ানো যায়।
চন্দ্রপৃষ্ঠের যে জায়গায় চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার নামাতে চাইছে ইসরো, সেই জায়গার অনেক ছবি চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার গত কয়েক বছরে পাঠিয়েছে। ফলে সেখানে ঠিক কতগুলো বোল্ডার এবং গর্ত আছে, সে বিষয়ে বেশ ভালো ধারণা পেয়েছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
চন্দ্রযান-১ অভিযানের প্রকল্প পরিচালক মিলস্বামী আন্নাদুরাই বিবিসিকে বলেন, “আমরা যদি মহাকাশের আরো গভীরে যাওয়ার জন্য চাঁদকে একটা স্টেশন বা আউটপোস্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তবে আরো বহু অভিযান আমাদের চালাতে হবে। চাঁদে যে ধরনের উপাদান পওয়া যাবে, তা দিয়ে কী করে সেখানে মানুষ থাকার উপযুক্ত একটি আবাসস্থল গড়ে তোলা যায় তা আমাদের জানতে হবে। সেখানে যারা থাকবেন, তাদের জন্য পৃথিবী থেকে নিয়মিত রসদ যোগানোর উপায় কী হবে, সেটাও জানতে হবে।”
এই বিজ্ঞানীর ভাষায়, “৩ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার দূরের ওই উপগ্রহ হয়ত কোনো এক দিন পৃথিবীর একটি দূরবর্তী মহাদেশে পরিণত হবে। আসলে, সেটাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।”