দ্বীপটির বিপুল খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার, যার বেশিরভাগ এখনও উত্তোলনই শুরু হয়নি, তার দিকে অনেকেই লোভাতুর চোখে তাকিয়ে আছে।
Published : 27 Jan 2025, 06:32 PM
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে বলে বসেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ পাবে বলে তার বিশ্বাস; আর্কটিকের এই দ্বীপটি পেতে তার যে আগ্রহ, এর পেছনে ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তা’ও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে হচ্ছে অনেকের।
স্বায়ত্তশাসিত ডেনিশ অঞ্চলটি তড়িঘড়ি করে তারা যে ‘বিক্রির জন্য নয়’ তা জানিয়ে দিলেও এর বিপুল খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার, যার বেশিরভাগ এখনও উত্তোলনই শুরু হয়নি, তার দিকে অনেকেই লোভাতুর চোখে তাকিয়ে আছে।
এই খনিজ সম্পদ, এর সম্ভাবনা ও সংকটের নানা দিক দেখতে বিবিসির এক প্রতিবেদক চষে বেড়ান দ্বীপটির নানা শহর, কথা বলেন অনেকের সঙ্গে।
তিনি জানান, গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ প্রান্ত, যেখানে দেখা মিলবে খাঁজকাটা ধূসর শৃঙ্গ ও সমুদ্রের আঁকাবাঁকা সব শাখার, সেখানেই রয়েছে খনিজের সমারোহ।
খনন কোম্পানি আমারক মিনারেলস খনিজের খোঁজে দুর্গম ওই অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছে; স্বর্ণখনি তো আছেই, এখন খুঁজছে তামা, নিকেল ও বিরল সব খনিজ উপাদান।
কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী এল্ডোর ওলাফসন অঞ্চলটির সম্ভাবনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “ওই খুব উঁচু সুঁচালো পাহাড়গুলো আসলে এক একটি সোনার খনি।”
আমারকের খনন লাইসেন্সের আওতা ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারে বেশি, নালুনাক পাহাড়ে তাদের স্বর্ণখনিটি তারা কেনে ২০১৫ সালে; এর আগের এক দশক খনিটি থেকে স্বর্ণ উত্তোলন করা হলেও স্বর্ণের দাম পড়ে যাওয়া ও খনির পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ায় এটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এ বছর থেকে খনিটি লাভজনক হবে বলে আশাবাদী ওলাফসন। আকরিক থেকে সোনার বার বানাতে নতুন একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র বানানো হয়েছে, যার দরুন উৎপাদনও বাড়বে।
ওলাফসন বলছেন, সম্ভাবনার দিক থেকে গ্রিনল্যান্ড অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কেননা এর বিপুল খনিজ সম্পদের বেশিরভাগেই এখনও স্পর্শ পড়েনি।
“পশ্চিমা বিশ্বে আগামী কয়েক দশকে যত খনিজ দরকার, গ্রিনল্যান্ড হতে পারে তার সরবরাহকারী,” ভাষ্য তার।
এরপরও দ্বীপটির মাত্র দুটি খনি থেকে খনিজ উত্তোলিত হচ্ছে।
আর্কটিকের এই দ্বীপে বিরল ভৌত উপাদানের অষ্টম বৃহত্তম রিজার্ভ রয়েছে, এসব বিরল উপাদান মোবাইল ফোন, ব্যাটারি ও ইলেকট্রিক মোটর বানাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আছে বিপুল পরিমাণ লিথিয়াম ও কোবাল্টও; তবে নতুন করে তেল ও গ্যাসের সন্ধানে ড্রিলিং এবং গভীর সমুদ্রে খননকাজ নিষিদ্ধ।
বিশ্বের এখনকার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো যখন বিরল ভৌত উপাদান সরবরাহ চেইনে চীনা আধিপত্যের বিকল্প খুঁজছে, তখন গ্রিনল্যান্ডের সম্পদ অনেককে আকৃষ্ট করছে।
“শক্তিশালী চীন গুরুত্বপূর্ণ এসব কাঁচামালের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল,” বলেছেন গ্রিনল্যান্ডের বিজনেস এসোসিয়েশনের পরিচালক ক্রিস্টিয়ান কিয়েল্দসেন।
তিন বিলিয়ন ডলারের খানিকটা বেশি জিডিপির এই স্বায়ত্তশাতি অঞ্চল মাছ ধরার ওপর ব্যাপক মাত্রার নির্ভরশীল। ডেনমার্কও তাদেরকে বছরে ৬০ কোটি ডলার ভর্তুকি দেয়।
দ্বীপটির খনিজের প্রতি এমনকী চীনেরও আগ্রহ আছে, যদিও তাদের উপস্থিতি খুবই সীমিত।
গ্রিনল্যান্ডের সর্ববৃহৎ বিরল ভৌত উপাদানের প্রজেক্ট চীনসংশ্লিষ্ট ক্রেতার কাছে বিক্রি না করতে অস্ট্রেলিয়ার একটি মাইনিং কোম্পানিতে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র লবিও করেছিল।
দ্বীপের ব্যবসা, বাণিজ্য ও কাঁচামাল বিষয়ক মন্ত্রী নায়া নেথানিলসেনও বলছেন, গত ৫ বছর ধরে দ্বীপের খনিজ নিয়ে বাড়তি আগ্রহ খেয়াল করছেন তিনি।
“আমরা জলবায়ু সংকটের হটস্পট হয়ে অভ্যস্ত। এখন এর সমাধানের অংশ হতে চাই,” বলেছেন তিনি।
এর অর্থ হচ্ছে, গ্রিনল্যান্ড খনিজ উত্তোলন বাড়িয়ে একদিকে যেমন নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চায়, তেমনি চায় এসব খনিজের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ও টেকসই উন্নয়নকে সমৃদ্ধ করতে।
এরই মধ্যে তারা ১০০টি ব্লকে খননকাজের অনুমতি দিয়েছে। এসব অনুমতির বেশিরভাগই পেয়েছে বিভিন্ন ব্রিটিশ, কানাডিয়ান ও অস্ট্রেলীয় কোম্পানি। লাইসেন্স পাওয়াদের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের আছে মাত্র একটি কোম্পানি।
অবশ্য লাইসেন্স পেলেও আর্কটিক এ ভূখণ্ডে খননকাজে প্রতিবন্ধকতাও প্রকট। দ্বীপটির ৮০ শতাংশই বরফে ঢাকা, বসতিগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত রাস্তাও নেই; এসবের পাশাপাশি প্রতিকূল আবহাওয়াও খনিজ উত্তোলনকে কঠিন করে তোলে, কোম্পানিগুলোর খরচ বেড়ে যায়।
“জলবায়ু বিবেচনায় প্রতিকূল আবহাওয়া ও সীমিত অবকাঠামোর মতো বেশকিছু সমস্যা রয়েছে আমাদের। তাই এখানে খনি শুরু করা বেশ ব্যয়বহুল,” বলেছেন জিওলজিকাল সার্ভে অব ডেনমার্ক অ্যান্ড গ্রিনল্যান্ডের ইয়াকভ ক্লাভে কেইডিং।
আছে লাল ফিতার দৌরাত্মও। দ্বীপটির কঠোর পরিবেশগত ও সামাজিক বিধিবিধানও লাইসেন্স পেতে দেরি করিয়ে দেয়।
নেথানিলসেন অবশ্য দেখছেন খননকাজে স্থানীয় অর্থনীতির সুবিধা, “তারা (বিদেশি খনি শ্রমিকরা) স্থানীয় দোকানে কেনাকাটা করবেন। তারা স্থানীয়দের চাকরি দেবেন। তারা স্থানীয়দের নৌকা বা হেলিকপ্টার ভাড়া নেবেন।”
কিন্তু স্থানীয়দের সন্দেহ যে কাটছে না।
“তারা যখন নতুন চাকরি যুক্ত করার কথা বলে, তখন আসলে কাদের কথা বলে?,” স্থানীয়দের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আদৌ রাখা হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের শহর কাকোরটোকের বাসিন্দা হাইডি মর্টেনসেন মাইলার।
এ ধরনের উদ্বেগ যে আছে তা স্বীকার করেছেন স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এসআইকের প্রধান জেস বের্টহালসেনও। তারপরও তিনি খনি খাতের বিকাশকে সমর্থনই করছেন।
“মাছ ধরা ছাড়াও অন্যান্য খাত থেকে গ্রিনল্যান্ডের আরও আয় দরকার,” বলেছেন তিনি।
দ্বীপটির রাজনীতিকরাও আশা করছেন, খনিজ উত্তোলনের আয় তাদের ডেনমার্কের ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে, শক্তিশালী করবে স্বাধীনতার প্রচেষ্টাকে।
নেথানিলসেনের আশা, আগামী দশকের মধ্যেই আরও অন্তত ৩-৫টি খনি চালু হবে।
যদিও গ্রিনল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হাভিয়ের আরনট এতটা আশাবাদী নন।
লাইসেন্স এত কম দেওয়া হয়েছে যে অগ্রগতিও সামান্য হবে, ধারণা তার।
গ্রিনল্যান্ড নিতে ট্রাম্প কী কী চাল দেন, সেগুলো শেষপর্যন্ত কাজে লাগবে কিনা তা এখনও পরিষ্কার নয়।
এদিকে ভূখণ্ডটির প্রধানমন্ত্রী মুটে এগেডে চলতি মাসের শুরুর দিকে বলেছিলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘ব্যবসা করতে’ চাই, খননকাজ ধরলে তাদের জন্য ‘দরজা খোলাই রয়েছে’।
বিজনেস এসোসিয়েশনের কিয়েল্দসেনও মনে করছেন, ট্রাম্পের আগ্রহ খনি খাতে ‘অতি দরকারি বিনিয়োগ’ নিয়ে আসবে।
“অন্যদিকে, ট্রাম্পের সংকেত ঘিরে অনিশ্চয়তা যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে, তাহলে বিনিয়োগ পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকিও বিদ্যমান,” বলেছেন তিনি।